ক্রীড়া প্রতিবেদক
মায়ের কথা রেখেছেন রোমান
খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চল কয়রা উপজেলার বাগালি গ্রাম। সুন্দরবন ঘেঁষা এই গ্রামের এক সময়কার গুলতিবাজ সুজনই এখন এশিয়ার সেরা তীরন্দাজ রোমান সানা। ফিলিপাইনে সদ্য সমাপ্ত এশিয়া কাপ ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং আর্চারি স্টেজ থ্রির রিকার্ভ এককে স্বর্ণ জিতে দেশকে সর্বোচ্চ সাফল্য এনে দিয়েছেন রোমান। ‘সোনার ছেলের’ এমন অর্জনে গর্বিত তার মা বিউটি বেগম।
তিন ভাই-বোনের মধ্যে রোমান সবার ছোট। আদর করে মা তাকে ডাকেন সুজন। স্কুলে ভর্তির সময় নাম হয় রোমান সানা। বড় ভাই বিপ্লব সানা, মেজ বোন লুবনা আক্তার ঝর্ণা। রোমানের বাবা গফুর সানা ও বড় ভাই বিপ্লব খুলনার পূর্ব রূপসার একটি মাছের আড়তে কর্মরত।
রোমানের বড় ভাই জানালেন, ছোটবেলা থেকেই মার্বেল ও গুলতি দিয়ে পাখি শিকারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন রোমান। রোদে ঘুরে আর কাদামাটি নিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন। বিভিন্ন সময়ে গুলতি দিয়ে অনেক পাখি শিকার করে নিশানায় হাত পাকিয়েছেন। বাবা গফুর সানার ভাষ্য, ‘গ্রামে থাকাকালে রোমানের গুলতির নিশানা ছিল চমৎকার। গাছে থাকা অনেক আমের মধ্য থেকে পাকা আমটি গুলতি দিয়েই নিচে নামাতে পারত।’
সে সময় সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর রোমানদের সবকিছু তছনছ করে দেয়। বিলীন হয়ে যায় তাদের ঘরবাড়ি। বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়ে খুলনায় চলে আসেন গফুর সানা। টুটপাড়ার একটি ঝুপড়ি ঘরে পরিবার নিয়ে ওঠেন। জানালেন, তখনকার অনাকাক্সিক্ষত এক ঘটনা কেড়ে নিতে পারত সোনা জয়ী রোমানের জীবন প্রদীপ যা আজও ভুলতে পারেনি তার পরিবার, ‘রোমান তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল। ওই সময় সে হঠাৎ বৈদ্যুতিক হিটারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা অচেতন ছিল। ওই ঘটনায় রোমান বেঁচে না থাকলে আজকের দিনটি হয়ত আর দেখা হতো না।’
খুলনার শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তীরন্দাজ হিসেবে রোমানের যাত্রা শুরু হয়। তখন ফেডারেশনের একটি টিম খুলনায় এসে তীরন্দাজ বাছাই ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। ওই স্কুলের শিক্ষক হাসানের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারেন রোমান। এরপর রোমান ওই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে সফলতার সঙ্গে তালিকাভুক্ত হন। তখন কোচ হিসেবে থাকা সাজ্জাদ হোসেন তার মা বিউটি বেগমকে ডেকে পাঠান। তাকে রাজি করিয়েই রোমানকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা নেন। তারপর থেকে রোমানের ‘জাতীয় তীরন্দাজ’ হয়ে ওঠার শুরু।
কিন্তু ২০১২ সালে এক দুর্ঘটনায় রোমানের পা ভেঙে গেলে তীরন্দাজ হওয়ার স্বপ্নটা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ফেডারেশনের সহায়তা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। ওই বছরই বাংলাদেশ গেমসে আনসারের হয়ে ভাঙা পায়ে সোনা জিতে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। এরপর একে একে আটটি স্বর্ণ জিতেছেন। এছাড়া তার ঝুলিতে অসংখ্য রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জও রয়েছে।
এশিয়ার সেরা আর্চারের মা বিউটি বেগম জানান, ‘বাছাই প্রশিক্ষণে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ছেলেকে খেলতে দিতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু দূরে যেতে দিতে মন চাচ্ছিল না। পরে যখন দেখলাম, সে এই খেলায় (আর্চারিতে) ভালো করছে, তখন আর আটকাইনি। আমি জানি ও যা করতে চায় সফলতা না পাওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়ে না।’
গর্বিত জননী আরো বলেন, ‘ফিলিপাইনে রোমানের সোনা জেতার খবরটি প্রথমে ছেলের বউ আমাকে জানায়। ওই খবরের পর এত বেশি খুশি হয়েছিলাম যে কান্না ধরে রাখতে পারিনি।’ যদিও রোমান সানা ফিলিপাইনে যাওয়ার আগে থেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন বিউটি বেগম। কিন্তু ছেলেকে তা বুঝতে দেননি। হাসপাতালে থেকে ছেলেকে ফোনে কথা বলে বিদায় জানিয়েছিলেন। দোয়া করে বলেছিলেন, ‘তুমি দেশের জন্য সুসংবাদ নিয়ে আসো।’ সেই কথাটিই গর্ব করে বললেন তিনি, ‘আমার সুজন আমার কথা রেখেছে।’
* খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবন ঘেঁষা বাগালি গ্রামে বেড়ে উঠেছেন
* মার্বেল ও গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করে কিংবা আম পেড়ে নিশানায় হাত পাকিয়েছেন
* ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের তা-বে তছনছ হয়ে যায় বসতবাড়ি
* ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকতে বৈদ্যুতিক হিটারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা অচেতন ছিলেন
* ২০১২ সালে এক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যায়
* ভাঙা পা নিয়েই বাংলাদেশ গেমসে স্বর্ণ জিতে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন
* সরাসরি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জনকারী প্রথম বাংলাদেশি
* ফিলিপাইনে যাওয়ার আগে গর্ভধারিণী মা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, বিষয়টি তার আজানা ছিল
* মাকে কথা দিয়েছিলেন দেশের হয়ে স্বর্ণ জিতবেন, অবশেষে সেটা করেই ছাড়লেন
"