শাহেদ শুভ্র হোসেন

  ১৬ মার্চ, ২০২৪

টুঙ্গিপাড়ার খোকা

মধুমতী নদীর পাড়ে ছায়াঢাকা, পাখিডাকা গাঁয়ে অনেক বছর আগে জন্মেছিল এক খোকা। অসীম সাহস ছিল তার, ছিল অফুরন্ত প্রাণশক্তি। আর ছিল মানুষকে ভালোবাসার বিশাল এক হৃদয়। যে হৃদয় দিয়ে মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারত সে। কী যে জাদু জানত খোকা! মানুষ তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই আপন করে নিত তাকে। সেই ছোটবেলা থেকেই মানুষের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল খোকা।

ছোটবেলায় সারা দিন সে ঘুরে বেড়াত গাঁয়ের ভেতর। খেলত, পড়ত, ঘুরত আর যখন তখন বন্ধুদের সঙ্গে হইহই রইরই করে মাতিয়ে রাখত সারা গ্রাম। সবাই তাকে ভালোবাসত। মায়ের যেমন চোখের মনি ছিল সে তেমনি ছিল বাবার আদরের ধন। বোনরাও কম ভালোবাসতেন না তাকে। খুব ছোটবেলায় তো কোল থেকে মাটিতেই নামতে দিত না খোকাকে।

পাড়া-প্রতিবেশীরাও তাকে স্নেহ করত। করবেই না কেন? সে যে ছিল লক্ষ্মী এক ছেলে। সবার বিপদে যেমন সে সবার আগে এগিয়ে যেত আবার সবার আনন্দের দিনেও সে সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিত।

যে স্কুলে পড়ত সেই স্কুলের শিক্ষকরাও তাকে স্নেহ করত। পড়াশোনায় সে ছিল সবার চেয়ে ভালো। স্কুল থেকে ফিরে রাতে খোকা পড়তে বসত বাবার কাছে। বাবা তাকে বাংলা পড়াতেন, ইংরেজি পড়াতেন, গণিত করাতেন, আরবি-ফারসি পড়াতেন।

তবে খোকার আগ্রহ ছিল ভূগোল আর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। হয়তো বড় হয়ে পৃথিবী বদলে দেওয়া একজন মানুষ হবেন- এমনটাই ধারণা ছিল তার বাবার। ধারণা তো হবেই। কথাবার্তা, কাজকর্মে সবার থেকে আলাদা ছিল যে খোকা।

স্কুলের গরিব কোনো শিক্ষার্থী বই-খাতা কিনতে না পারলে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসত খোকা। খুব গরিব ছাত্ররা মাঝে মাঝে সেকালে খালি গায়ে আসত স্কুলে। এ রকম ছাত্রদের জামা কিনে দিত খোকা। খোকার বাবা-মা তার বিভিন্ন কাজে কখনো রাগ করতেন না। বরং তারা জানত তাদের খোকা কোনো দিন ভুল কাজ করবে না।

একবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল সারা বাংলায়। খোকাদের গ্রামেও সে দুর্ভিক্ষের প্রভাব এসে পড়েছিল। গ্রামের মানুষকে না খেয়ে থাকতে দেখে খোকার ছোট্ট বুকটা ব্যথায় ভরে যায়। বাড়ি ফিরে ধানের গোলা থেকে অকাতরে গ্রামের মানুষদের জন্য ধান বিলিয়ে দিতে লাগল সে। মানুষ তৃপ্তি করে পেট ভরে ভাত খেল। ভাত খেয়ে খোকার জন্য দোয়া করল। জীবনে চলার পথে সব সময়ই তার জন্য ছিল অসহায় মানুষের মন থেকে দোয়া। সে দোয়া বিফলে যায়নি। এক দিন ঠিকই কাজে লেগেছিল।

নিজের গায়ের নতুন চাদর শীতে জবুথবু হয়ে পড়া মানুষের গায়ে পরিয়ে দিয়ে নিজে খালি গায়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরত খোকা। নিজেকে নিয়ে খুব কমই ভাবত সে। তার ভাবনা জুড়ে ছিল শুধুই মানুষ।

খেলাধুলাতেও ছিল খোকা বেশ ভালো। চমৎকার ফুটবল খেলত। সেই বয়সেই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে জেলাপর্যায়েও নাম করেছিল খোকা। খেলার মাঠে তার পায়ে বল গেলেই উল্লাসে মেতে উঠত দর্শক। কত খেলায় যে জয়লাভ করেছিল তার দল সে হিসাব নেই।

পড়াশোনায় ভালো বলে বাবা তাকে জেলা শহরের এক স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সে স্কুলেও তার খুব সুনাম হয়। পড়তে পড়তেই একসময় তার চোখের অসুখ হয়। সবাই তো ভেবেছিল চোখ জোড়া বুঝি নষ্টই হয়ে গেল আজীবনের জন্য। চিকিৎসা আর মানুষের আশীর্বাদে চোখ ভালো হয়ে যায় তার। তবে কয়েক বছর খুব কষ্ট পেতে হয় তাকে। কিন্তু চোখ ভালো হলেও চশমা হয়ে ওঠে তার নিত্যসঙ্গী। তাই আগের মতো আর খেলাধুলায় মন বসাতে পারে না সে। খেলাধুলা না করলেও তার মন পড়ে থাকে মানুষের মাঝে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাকে খুব পীড়া দেয়। মানুষের জন্য কিছু একটা করার জন্য সব সময়ই তার মন কাঁদতে থাকে।

তখন ছিল ব্রিটিশ আমল। ব্রিটিশদের হাত থেকে পরাধীন দেশটাকে মুক্ত করার কথা ভাবত খোকা। বাংলার বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সেই মফস্বল শহরে থাকতেই তার পরিচয় হয়েছিল শুধু নেতৃত্বের গুণাবলির জন্য। বড় নেতারা বুঝতে পেরেছিল এই ছেলে আর আট দশটা ছেলের মতো নয়। এ সবার থেকে আলাদা। এই ছেলে বড় হয়ে এক দিন অনেক বড় মানুষ হবে।

তারপর সেই মফস্বল শহরের গণ্ডি পেরিয়ে খোকা পড়াশোনা করতে যায় কলকাতায়। কলকাতার পড়ালেখা শেষ করে চলে আসেন ঢাকায়। কিন্তু এবার আর পড়ালেখা শেষ করতে পারে না খোকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানুষের জন্য রাজনীতি করতে যেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল করে। এ নিয়ে তার মনে কোনো দুঃখ ছিল না। মানুষের অধিকার আদায়ে হাসি মুখেই মেনে নিয়েছিল সে এই সিদ্ধান্ত।

তারপর। তারপর আর থেমে থাকতে হয়নি খোকাকে। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের চরম দুঃশাসন, অনাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে করতে সেই ছোট্ট খোকা এক দিন হয়ে ওঠেন আপামর সাধারণের প্রিয় বঙ্গবন্ধু। হ্যাঁ, বাংলার অকৃত্রিম বন্ধু যিনি। পরাধীন এই দেশটাকে পাকিস্তানি দুঃশাসন থেকে থেকে মুক্ত করতে ডাক দেন স্বাধীনতার।

তার ডাক রেসকোর্স ময়দান থেকে পৌঁছে যায় বাংলার সব মুক্তিকামী মানুষের কানে। শুরু হয় মরণপণ লড়াই। সবাই জানত বিজয় হবেই এক দিন, হয়েছিলও তাই। জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের।

যে স্বাধীনতার স্বপ্ন এক দিন এক ছোট্ট কিশোর দেখেছিল তার প্রিয় মাতৃভূমিকে নিয়ে। সেই স্বপ্ন সত্যি সত্যিই পূরণ হয় এক দিন তার নিজের হাতেই। তিনি এনে দেন স্বাধীন এক দেশ। একটি পতাকা। একটি মানচিত্র। লাল সবুজের একটি দেশ। যে দেশের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে খোকার স্বপ্ন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close