কবির কাঞ্চন
ভালোবাসার বল্টু ও পল্টু
অতিথি হয়েই বল্টু ও পল্টুর এ বাসায় প্রথম আসা। বল্টুর চেয়ে পল্টু কয়েক মাসের বড় হবে। এক দিন প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে আশ্রয়ের জন্য শীতল চৌধুরীর বেডরুমের জানালা খোলা পেয়ে ঢুকেছিল।
সেই ছোটবেলা থেকে পশুপাখির প্রতি শীতল চৌধুরীর ছিল গভীর মমতা। স্ত্রী রুনা ইসলাম ওদের বাসা থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইলে তিনি সামনে দাঁড়িয়ে বললেন-
- থাক না, ওরা। একটু আশ্রুয়ের জন্যই তো আমাদের কাছে এসেছে। তাছাড়া বাইরে খুব বৃষ্টি ও ঝড় হচ্ছে।
- তাই বলে বাড়তি ঝামেলা ঘরের মধ্যে রাখব!
- ঝামেলা বলছ কেন?
- ঝামেলা বলব না তো কি বলব? প্রতিদিন ওদের জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করতে হবে। তাছাড়া ওদের দেখলে আমাদের বন্যাও তো ভয় পেতে পারে।
- আমরা তো প্রতিদিন কতো উদ্বৃত্ত খাবার ফেলে দিই। বন্যা মামণির নষ্ট করা খাবার, বাসার উচ্ছিষ্ট অংশ ওদের দিলে পেট ভরে খাবে। তাতে করে ঘরের ময়লাও কমে যাবে। আর দেখ, বন্যা মামণি ওদেরকে কাছে পেয়ে আনন্দিত হবে। বাচ্চারা পশুপাখি পুষতে ভালোবাসে, জানো না?
- তাহলে তো ভালো হয়। দেখো পরে যেন কোনো ঝামেলার মধ্যে না পড়ি।
শীতল চৌধুরী মৃদু হেসে বললেন-
- ঝামেলা যত আমার জন্য রেখে দাও। সেসব আমিই সামলাব।
এই কথা বলে রান্নাঘর থেকে কিছু খাবার নিয়ে এসে ওদের সামনে ফ্লোরে রাখলেন। বিড়ালদ্বয় খুব মজা করে খেতে লাগল। শীতল চৌধুরী অপলক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বিড়ালদ্বয়ও খাওয়ার ফাঁকে তার দিকে তাকিয়ে আবার খেতে লাগল। ওদের খাওয়ার ধরন দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্ষু ধার্ত ছিল। ওরা অভুক্ত মানুষের মতো প্লেটের সব খাবার মুহূর্তে সাবাড় করল।
শীতল চৌধুরী স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-
- বিড়ালগুলো কতটা ক্ষুধার্ত ছিল! দেখেছ, রুনা! ওদের না খাইয়ে তাড়িয়ে দিলে খুব অন্যায় হয়ে যেত, তাই নয় কি?
- হ্যাঁ, তুমি একদম ঠিক বলেছ। খাবারগুলো তো এমনিতেই ফেলে দিতাম। তাছাড়া গতকালকের মাছের কাটাও ওরা খুব মজা করে খেয়েছে।
- আরেকটা কথা বলি। এরা বাসায় থাকলে তোমার জিনিসপত্রের রক্ষণাবেক্ষণও ভালো হবে।
রুনা ইসলাম বিস্মিত হয়ে বললেন-
- তার মানে তো বুঝলাম না।
- আরে, না বোঝার কি আছে! আমি বলছিলাম, কারোর ঘরে বিড়াল থাকলে ইঁদুর থাকে না। আর ইঁদুর না থাকলে তোমার জিনিসপত্র নষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগও থাকছে না।
- ওহ্! আচ্ছা, এই কথা!
এই কথা বলে রুনা ইসলাম হো হো হেসে উঠলেন। স্ত্রীকে এভাবে হাসতে দেখে শীতল চৌধুরীও হাসিতে শরিক হলেন।
বাবা-মায়ের হাসির শব্দে বন্যার ঘুম ভেঙে যায়। সে দৌড়ে এসে ঘুম ঘুম চোখে বিড়াল দুটির সামনে ফ্লোরে বসে খেলতে শুরু করল।
বিড়ালগুলোকে কাছে পেয়ে বন্যা যেন নতুন করে প্রিয়সঙ্গীকে খুঁজে পেল। ইট-পাথরের এই শহরে বাবা-মা ছাড়া একান্তে খেলার কোন সাথি পায়নি সে। জন্মের পর থেকে বাবাকে দেখে পশুপাখির প্রতি বন্যারও মমত্ব বাড়ে। মাত্র অল্প সময়ের মধ্যে বিড়ালগুলোকে আপন করে নেয় বন্যা। তার এমন আনন্দ দেখে শীতল চৌধুরী খুব খুশি হন।
এরপর সময় যতই গড়াতে থাকে, বিড়ালগুলোর সঙ্গে শীতল চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের সখ্যতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যে বিড়াল দুটির আলাদা নাম দেয়া হয়েছে। একটির নাম বল্টু। আরেকটির নাম পল্টু।
প্রতিদিন বিড়ালের খাবার নিশ্চিত করে স্কুলের পথে পা বাড়ায় বন্যা। বল্টু ও পল্টু বন্যাকে কাছে পেলে যেন স্বর্গ ফিরে পায়। সারাক্ষণ বন্যার পিছে ঘুরঘুর করে। বন্যা যখন পড়তে বসে তখন ওরা সুবোধ বিড়ালের মতো কিছু দূরে বসে থাকে। বন্যা তা লক্ষ্য করে। পড়ার ফাঁকে বিড়ালগুলোকে চোখে চোখে রাখে সে। ওদের পেয়ে বেশ হেসেখেলে সময় কাটছে তার।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে ব্যাগটা পড়ার টেবিলে রেখে এদিকওদিক লক্ষ্য করে। রুমে বল্টু ও পল্টু নেই। বন্যা বিস্মিত হয়। স্কুল থেকে ফিরলে প্রতিদিন ওরা বন্যাকে সাদরে গ্রহণ করে। কিন্তু আজ ওরা রুমে নেই। তবে কি ঘরের অন্য কোথাও লুকিয়ে মজা করছে? এইসব ভাবতে ভাবতে এ রুম ও রুম করতে করতে পুরো ঘরে ঘুরে ঘুরে দেখল। বল্টু ও পল্টু কোথাও নেই। আব ার পড়ার রুমের দিকে ফিরে আসে সে। বন্যার পড়ার রুমের দরজার পাশেই এককোণে বল্টু ও পল্টু থাকতো, খেতো। বন্যা লক্ষ্য করলো। দুজনের খাবারের পুরনো দুটি প্লেটও অগোছালোভাবে পড়ে আছে। ফ্লোরে কিছু খাবারও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বন্যার বুঝতে বাকী রইলো না। নিশ্চয় এখানে কেউ এসেছিল। ওদের ধরে নিয়ে গেছে। মুহূর্তে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে ফিরে আসে সে।
রুনা ইসলাম মেয়েকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন,
- এত কান্না করতে হবে না। বল্টু ও পল্টু চলে গেছে তো কী হয়েছে? তোমাকে আমরা ওদের চেয়ে সুন্দর বিড়াল এনে দেব। এখন ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো।
আর কোন কথা না বাড়িয়ে বন্যা তার পড়ার রুমের দিকে চলে আসে। পড়ার রুমের পাশেই তার শোবার খাট। বন্যা ধপাশ করে খাটের উপর চিত হয়ে শুয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল।
সারাদিন কেটে গেল। মা-বাবা অনেক চেষ্টা করেও তার মুখে খাবার তুলে দিতে পারলেন না। তারা বন্যাকে নিয়ে রীতিমতো বিপদে পড়ে গেলেন।
পরদিন বন্যা স্কুলেও যায়নি। মন খারাপ করে শুয়ে আছে।
মেয়েকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে শীতল চৌধুরীও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসেন। পরিবারের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি শিশুপার্কে চলে আসেন। বন্যাকে গোমরা মুখে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে এটাওটা কিনে দেন। কিন্তু কোনোকিছুতেই বন্যার মন ভরে না।
উল্টো সে বাসায় ফিরতে বাবার কাছে বায়না ধরে। সে বাবাকে আস্তে করে বলল-
- বাবা, চল আমরা বাসায় ফিরে যাই। এতক্ষণে নিশ্চয় আমার প্রিয় বল্টু-পল্টু চলে এসেছে। ওরা আমাকে না পেয়ে হয়তো খুব চিন্তা করছে।
- কি বলছিস! আজ দু’দিন ধরে ওদের খুঁজতে খুঁজতে আমরা হয়রান হয়ে গেছি। কোথাও খোঁজে পেলাম না। এখন ওরা বাসায় এসে তোর জন্য চিন্তা করবে?
বন্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-
- তোমরা জানো না। আমার মন বলছে ওরা কোন বিপদে পড়েছে। তবে যত বিপদেই পড়–ক না কেন ওরা সুযোগ পেলেই আমার কাছে ছুটে আসবে।
- তাই বলে এখন?
- হ্যাঁ, আমার মন তা বলছে।
- আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে চল।
এই কথা বলে তারা বাসায় ফিরে আসে। বাসার সামনে আসতেই বল্টু ও পল্টু বন্যাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে ছুটে আসে।
বন্যা বল্টু ও পল্টুকে কাছে পেয়ে আনন্দে ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে ওঠে। প্রথমে বল্টুকে এরপর পল্টুকে ভালো করে দেখে নেয়। বল্টু-পল্টুর শরীরের বেশ কিছু পশম নেই। এই দুইদিনে রোগাটে চেহারা হয়ে গেছে। বন্যার দিকে তাকিয়ে আছে বল্টু-পল্টু। ওদেরও চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।
বন্যা মুহূর্তে বল্টু ও পল্টুকে কোলে তুলে নিয়ে গলায় জড়িয়ে ধরে রাখে।
ততক্ষণে শীতল চৌধুরী বাসার তালা খুলে মেয়েকে নিয়ে বাসার ভেতরে চলে আসেন। বল্টু-পল্টুকে দ্রুত খাবার খেতে দেন। কিন্তু ওরা খাবার না খেয়ে বন্যার দুই পাশে চুপচাপ বসে আছে।
শীতল চৌধুরী বল্টু ও পল্টুর চেহারা দেখে বুঝতে পারেন ওরা খুব ক্ষুধার্ত। শুধু বন্যার জন্য খাচ্ছে না। এরপর তিনি
স্ত্রী রুনা ইসলামকে সবার খাবার রেডি করতে বললেন।
"