নিজস্ব প্রতিবেদক
ইসির সঙ্গে সংলাপে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির পরামর্শ
আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন দেশের গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। প্রিন্ট মিডিয়ার এসব সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে আস্থা অর্জনের কথাও বলেছেন। এর আগে অনুষ্ঠিত প্রথম সংলাপে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও অনুরূপ পরামর্শ দিয়েছিলেন।
একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আইন সংস্কার, সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ ঘোষিত রোডম্যাপ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে গতকাল বুধবার সংলাপে গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা এ মত তুলে ধরেন। সংলাপে গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, প্রার্থীদের মানদন্ড নির্ণয়ে নির্বাচনে ‘না’ ভোটের বিধান বহাল করা, অনলাইনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণের বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শও দেন। তবে সংলাপে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রে পক্ষে-বিপক্ষে মত এসেছে।
সংলাপ শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ইসির ভারপ্রাপ্ত হেলালুদ্দীন আহমদ জানান, নির্বাচন কমিশন সব পর্যায়ের অংশীজনদের মতামত জানার জন্য ধারাবাহিক-ভাবে সংলাপের আয়োজন করেছে। এই সংলাপ থেকে যেসব মতামত কিংবা সুপারিশ আসবে, সেসব বিষয় নিয়ে ইসি কমিশনাররা আলাদাভাবে বসে তাদের করণীয় নির্ধারণ করবেন। সংলাপের মাধ্যমে কমিশন নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি এবং কিভাবে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারে, তা নির্ধারণই এই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) খান মো. নুরুল হুদার সভাপতিত্বে সকাল ১০টায় সংলাপ শুরু হয়ে দুপুর দেড়টায় শেষ হয়। সিইসি ছাড়াও চার নির্বাচন কমিশনার, কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রিত ৩৬ জন সাংবাদিকের মধ্যে ২৬ জন উপস্থিত ছিলেন। গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের দুই দিনব্যাপী এই সংলাপের আজ দ্বিতীয় দিনে টেলিভিশন ও অনলাইন পোর্টালের গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা তাদের মত তুলে ধরবেন। সংলাপে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর নির্বাচনে সেনা মোতায়েন ও নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির প্রস্তাব দেন। তিনি বিএনপির নাম উল্লেখ করে বলেন, বর্তমানে ওই দলটির অনেক নেতার নামে মামলা রয়েছে। ওই মামলার সূত্র ধরে নির্বাচনের সময় তাদের যেন হয়রানির শিকার হতে না হয়, তার জন্য নির্বাচনকালে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের মামলার হয়রানি থেকে রেহাই দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি সেনা মোতায়েনের পক্ষে মত দেন।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘আমাদের এখানে নির্বাচন একটা উৎসবের মতো। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইসির আস্থা অর্জন করতে হবে। এর জন্য সব দলের অংশগ্রহণ যেন নিশ্চিত করা যায়; সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি অনুযায়ী বলা যায়, আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার দরকার নেই।’
মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতা প্রয়োগের চেষ্টা চালালে প্রয়োজনে ওই দলকে লাল কার্ড দেখাতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে কে ক্ষমতাধর, কে নয়, তা কমিশনের কাছে বিবেচ্য বিষয় হবে না। ইসি যে সাংবিধানিক সংস্থা, সেটা প্রমাণ করতে হবে। সংলাপ শেষে গণমাধ্যমের কাছে এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বলেন, ‘আমি সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে মত দিয়েছি। বলেছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হয়। আমরা কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নই যে, আমাদের এখানে সেনা মোতায়েন করা যাবে না।’
ইংরেজি দৈনিক নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবীর বলেন, নির্বাচনের সময় নির্বাহী বিভাগ ইসির অধীনে থাকবে। তখন কমিশন নিজেদের শক্তিশালী দেখতে চায় কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।
নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে মত দিয়েছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট। ২০০১ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনী ছিল। সেনাবাহিনী থাকার পরও সেখানে দেখেছি নির্বাচনের পরপরই জামায়াত-শিবির ও বিএনপি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলে পড়েছিল। কাজেই নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে জঙ্গি দমনে ভূমিকা রাখছে, তেমনি সুষ্ঠু নির্বাচনেও তারা যথেষ্ট। নির্বাচন কমিশনই এসব বিষয়ে ভূমিকা রাখবে। আমি কমিশনকে অযোগ্য মনে করি না।’
সংলাপ থেকে বেরিয়ে গণমাধ্যমের কাছে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই ধরনের নির্বাচন যেন ভবিষ্যতে না হয়, সেজন্য কমিশনকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে তিন বছর মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেননিÑএমন কর্মকর্তাদের পদায়ন না দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সংলাপে অংশগ্রহণকারী দু-একজন ছাড়া সবাই সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা বলেছেন।
যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, সংলাপে দেওয়া মতামতগুলো প্রকাশ করার কথা বলা হয়েছে। কোনো অবস্থায় প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করা যাবে না। কারণ প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করার চেয়ে না করাই শ্রেয়। সংসদীয় আসনের সীমানা বিন্যাস করার ক্ষেত্রে সংসদীয় আসনের আয়তন ও ভোটার সংখ্যাকে বিবেচনায় নিয়ে পুনঃবণ্টনের কাজ করতে হবে ইসিকে। তিনি আরো বলেন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের বিধিবিধান অনুসরণ করে চলবে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখতে পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনকে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে যা দরকার সেসব প্রস্তাব করেছি। সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নির্বাচনের কথা বলেছি। ইসি যদি মনে করে সেনাবাহিনীর দরকার, তাহলে মোতায়েন করবে, না চাইলে নয়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছি। এ ছাড়া জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করে কালোটাকার পথ নিয়ন্ত্রণের কথাও বলেন এই সম্পাদক। তিনি বলেন, কিছু আসন পুনর্বিন্যাস করা দরকার।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলেছি। প্রত্যেক দল যেন ৩৩ শতাংশ নারীর নেতৃত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করে, সে বিষয়ে কমিশনকে পদক্ষেপ নিতে বলেছি। ভিন্ন কোনো নামে যেন জামায়াত নিবন্ধিত হতে না পারে, কমিশনকে তার জন্য সতর্ক থাকতে বলেছি।
সংলাপে গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা আরো বলেন, সাধারণ ভোটাররা যাতে ভোট দিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনের আগে অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাসীদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রতিনিধিদের কেউ কেউ বিদ্যমান সীমানাতেই ভোট করার পরামর্শ দেন। তাদের মতে, জনসংখ্যার ভিত্তিতেই সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। ২০১১ সালে সর্বশেষ আদমশুমারি প্রতিবেদন হওয়ায় নতুন করে আর সীমানা পুনর্নির্ধারণের দরকার নেই।
প্রতিনিধিরা এমনও মত দেন, আসন্ন ৬ সিটি নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচনী প্রচারণায় সমান সুযোগ রাখতে হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনে জোটভিত্তিক রাজনৈতিক দল নির্বাচন করলেও নিজ নিজ দলের প্রতীক নিয়ে যাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা, সে বিষয়ে আরপিওতে সুস্পষ্ট করতে হবে।
সংলাপে অন্যান্যের মধ্যে ইত্তেফাকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আশিস সৈকত, কালের কণ্ঠ নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, আমাদের অর্থনীতি সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান, বিএফইউজের একাংশের মহাসচিব ওমর ফারুক, বিএফইউজের অপর অংশের মহাসচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক ও যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মর্তুজা, কলাম লেখক বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাহবুব কামাল, দৈনিক সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান, যায়যায়দিনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী রুকুনউদ্দীন আহমেদ, সাংবাদিক কাজী সিরাজ ও সাংবাদিক আনিস আলমগীর উপস্থিত ছিলেন ও মত দেন।
"