কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ২৫ জুলাই, ২০১৭

অস্বাভাবিক বর্ষণ আর জোয়ারের পানি

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে চট্টগ্রাম

প্রবল বর্ষণ আর অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। তিন ধরে চলছে টানা বর্ষণ। থামার কোনো লক্ষণ নেই। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের জনজীবন। অর্ধেক এলাকা তলিয়ে গেছে কয়েক ফুট পানির নিচে। শহরের ভেতর যান চলাচল কার্যত বন্ধ। দেশের ওয়ালস্ট্রিট বলে খ্যাত খাতুনগঞ্জ তলিয়ে যাওয়ায় শত শত কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে।

শহরের বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবনের পুরো এক তলা পানির নিচে চলে যাওয়ায় বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন বাসিন্দারা। নগরীর বিভিন্ন এলাকার স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী নির্ধারিত দিনে পরীক্ষা দিতে পারেনি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেশির ভাগ কাজে যেতে পারছে না। শহরের বিশাল এলাকা বিদ্যুৎ ও গ্যাসহীন হয়ে পড়েছে। অনেকের দিনভর কেটেছে উপোস। চট্টগ্রামের সাথে বান্দরবানের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাস হচ্ছে না। পণ্য নিয়ে শহর থেকে খুব কমসংখ্যক গাড়ি ছেড়েছে।

এদিকে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকায় এক মিনিট স্থায়ী টর্নেডো হানা দেয়। নিমিষেই এখানকার শতাধিক দোকানপাট বিধ্বস্ত হয়। এ ধরনের বিপর্যয় এলাকাবাসী আর কখনো দেখেনি। বহুদূর পর্যন্ত দোকানের চাল উড়ে যায়।

চট্টগ্রামে এখন যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত তিন দিনে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরে ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই যেখানে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়, সেখানে গত তিন দিনের ছয় গুণ বৃষ্টিতে নেমে এসেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। চট্টগ্রাম শহরের কিছু উঁচু এলাকা ছাড়া বেশির ভাগ এলাকা এখন পানির নিচে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় চেয়ে দেখা ছাড়া যেন কিছুই করার নেই মানুষের। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ দেখা দিয়েছে নগরীর হালিশহর, আগ্রাবাদ, বাকলিয়া, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকায়। অথচ এসব এলাকাই জনবহুল। এত দিন ঝড়-বৃষ্টি এসব এলাকার মানুষ সামলে নিয়েছিল। কিন্তু এবার জোয়ারের পানি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি আর জোয়ারের পানির পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে ৬ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত। এসব এলাকায় যেসব পরিবার একতলা বা কাঁচা ঘরে রয়েছে তাদের দুর্ভোগ চরমে। অনেকে বহুতল ভবনে আত্মীয়স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ চলে গেছেন শহরের বাইরে আত্মীয়দের কাছে।

চলমান এ দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে দেশের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ে। প্রতিদিন এখান থেকে হাজারো ট্রাক পণ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। গতকাল সোমবার ছিল ব্যতিক্রম। পানির জন্য থমকে গেছে পণ্য আনা-নেওয়া। খাতুনগঞ্জের চালের আড়তে পানি ঢুকে টনকে টন চাল নষ্ট হয়েছে। চাক্তাই এলাকার বেশির ভাগ গুদামে পানি ঢুকে একাকার হয়ে যাওয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন। পণ্য রাখার বিকল্প জায়গা না থাকায় ব্যবসায়ীদের বড় অংশেরই তাকিয়ে ক্ষতি দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। আগের অভিজ্ঞতার কারণে অনেক ব্যবসায়ী গুদামের মুখে দুই ফুটেরও বেশি উঁচু দেয়াল তুলেছিল। কিন্তু এবারের জোয়ারের পানি ঢুকেছে দেয়াল উপচে। গত ২০/২৫ বছরেও এ ধরনের জোয়ারের পানি নজরে আসেনি বলে ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করেন। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী নেতা সৈয়দ সগীর আহমেদ জানান, এই বর্ষা ও জোয়ারে ব্যবসায়ীদের ৩০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হবে।

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় রয়েছে বেসরকারি মা ও শিশু হাসপাতাল। এ হাসপাতালটি বিশাল এলাকার জনগোষ্ঠীকে সেবা দিয়ে আসছে। বর্তমানে এ হাসপাতালের নিচের তলায় কয়েক ফুট পানি। ফলে সেখানকার রোগীদের কষ্ট চরমে। আর যানবাহনের অভাবে নতুন রোগী তো আনাই যাচ্ছে না। কোমর পানির নিচে এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় ডাক্তার ও ছাত্র-ছাত্রীদের হাসপাতালে ঢুকতে পারছেন না। আগ্রাবাদে রয়েছে বেশির ভাগ কর অফিস। এ অফিসগুলো এখন পানির নিচে। অফিসে যাতায়াতের জন্য নৌকা কিনতে হয়েছে কর কর্মকর্তাদের। সেটির দাম পড়েছে ২৫ হাজার টাকা। এটা দিয়ে এখন চলছে তাদের অফিসে আসা-যাওয়া।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ভাটা পড়েছে। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানির কারণে বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে বাইরে যেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। অস্বাভাবিক পানির কারণে যানবাহনের ভাড়া বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। বন্ধ রয়েছে বহির্নোঙ্গরে পণ্য ওঠানো-নামানো। সাগর উত্তাল হওয়ার কারণে সাগরে দাঁড়িয়ে থাকা বড় জাহাজগুলোর ধারেকাছে ভিড়তে পারেনি কার্গো জাহাজ। সাগর উত্তাল হওয়ার কারণে কেউ ঝুঁকি নিয়ে পণ্য খালাস করতে যায়নি। ফলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে জাহাজগুলো।

চট্টগ্রাম বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বিমান চলাচলের শিডিউল এলোমেলো হয়ে গেছে। বেশির ভাগ বিমান সময়মতো ছাড়তে পারেনি। বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেকে শিডিউল বাতিল করেছে।

নগরীর লাখ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকদের দিন যাচ্ছে অসহায়ভাবে। নিচু এলাকায় বাস করা এই শ্রমিকদের অনেকেই বৃষ্টি আর জোয়ারের পানির সাথে যুদ্ধ করে কর্মস্থলে যেতে পারেননি। যারা গেছেন তারা ফিরে ঘর ল-ভ- দেখে অসহায় হয়ে পড়েন।

এদিকে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাহাড়ে যেসব মানুষ এখনো রয়ে গেছে তাদের এলাকা ছেড়ে নিরাপদে চলে আসার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কাটা পাহাড়গুলোতে বড় ধরনের ধস নামতে পারে বলে শঙ্কায় রয়েছে প্রশাসন।

এদিকে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি ছেড়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণের ফলে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেতরে থাকা পানি ছেড়ে দেওয়া হলে কর্ণফুলি, হালদা নদীতে চাপ সৃষ্টি হয়। প্রায় ৫৪ কিউসেক পানি ছাড়া হয়েছে বলে সূত্র জানায়। এতে চট্টগ্রামের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চট্টগ্রাম,প্রাকৃতিক বিপর্যয়
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist