বিশেষ প্রতিবেদক

  ০১ এপ্রিল, ২০২৪

২০৫ অটোরিকশা প্রতিস্থাপনে তিন কোটি টাকা ঘুষ!

মিশুককে সিএনজি অটোরিকশায় প্রতিস্থাপনে ২ কোটি টাকার বেশি ঘুষবাণিজ্য হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএর দুই কর্মকর্তা, সিএনজি অটোরিকশা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের কিছু নেতা এই ঘুষ নিয়েছেন। এ ব্যাপারে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবং বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে গতকাল রবিবার লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন।

লিখিত অভিযোগপত্রে ঘুষবাণিজ্যে নাম ওঠে আসে ঢাকা বিভাগ বিআরটিএর তৎকালীন উপপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মাসুদ আলম ও সহকারী পরিচালক সামসুল কবির, ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি (মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি) বরকত উল্লাহ ভুলু ও সাধারণ সম্পাদক (মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি) মোশারফ হোসেনের নাম।

জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৭ আগস্ট তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ঢাকা মহানগরীতে ২৬৯৬টি মিশুকের পরিবর্তে সমপরিমাণ সিএনজি অটোরিকশা প্রতিস্থাপনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, যথাসময়ে ২ হাজার ২৪০টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে কিছু অটোরিকশা প্রতিস্থাপন দেওয়ার পর আইনি জটিলতার কারণে ২০৫টি মিশুকের প্রতিস্থাপন স্থগিত হয়ে যায়। এসব মিশুকের আবেদন ও কাগজপত্রে দেখা দেয় জটিলতা। এসব মিশুকের রেজিস্ট্রেশন পেতে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ বুলু ও সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। এতে ৫১ জন মিশুক মালিক রিটে সই করেন। পরে হাইকোর্ট ২০৫টি মিশুকের বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে লিখিতভাবে তথ্য জানতে চান। বিআরটিএ চেয়ারম্যান পরে হাইকোর্টকে জানান, ২০৫টি মিশুকের যাবতীয় কাগজপত্র পর্যালোচনা করে ৭৭টি আবেদন কাগজপত্র সঠিক রয়েছে। বাকি ১২৮টি আবেদনপত্রে জটিলতা রয়েছে।

অভিযোগ আছে, এই জটিলতা কাটিয়ে রেজিস্ট্রেশন পেতে টাকা লেনদেন করে বিআরটিএ’র কর্মকর্তা তৎকালীন উপপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মাসুদ আলম ও সহকারী পরিচালক সামসুল কবির। প্রতিটি আবেদনের বিপরীতে নেওয়া হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এতে হিসেব কষে দেখা যায়, ২০৫টি আবেদনের বিপরীতে ৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঘুষবাণিজ্য করেন হয়।

সূত্র বলছে, পরবর্তীতে মিশুক থেকে সিএনজি অটোরিকশা প্রতিস্থাপনে জটিলতা দেখা দেওয়ায় হাইকোর্ট রেজিস্ট্রেশন স্থগিত করেন। পরে রিট পিটিশনকারী ও বিআরটিএ’র অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাযাজশে ২০৫টি মিশুকের পরিবর্তে সিএনজি অটোরিকশা প্রতিস্থাপন দেওয়া হয়। ২০৫টির মধ্যে ১৯টি মিশুক ইসলামী ব্যাংক ও ফয়সাল ইনভেস্টমেন্টের কাছে দায়বদ্ধ ছিল বলে জানা যায়। এক্ষেত্রে অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের বৈধ ছাড়পত্রও আনা হয়নি। এছাড়া ১১৬টি গাড়ি বিভিন্ন অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়বদ্ধ। তারপরও এগুলো দেওয়া হয় বৈধতা।

জানা যায়, জটিলতায় থাকা ২০৫টির মধ্যে ১১৬টি অটোরিকশা ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ ভুলু ও সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেনের। এর মধ্যে ৩১টি মোশারফ হোসেনের নিজের নামে। ১৮টি তার শ্যালক শরিফুল ইসলামের নামে। নিকটতম আত্মীয় আবদুল মালেকের নামে ১৩টি ও রবিউল আলম ৩৬টি এবং জসিম উদ্দিনের নামে ১৮টি।

এ বিষয়ে ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন করে সুষ্ঠু তদন্ত করে ২০৫টি মিশুকের আবেদনের মধ্যে বৈধ ৭৭টি মিশুকের প্রতিস্থাপন দেওয়া হলে বাকি ১২৮টি মিশুকের পরিবর্তে সিএনজি অটোরিকশা প্রতিস্থাপন বাতিল করা করা উচিত। তা না হলে আদালত অবমাননার মামলা করা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়াবে।

বিআরটিএ এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিধি অনুসারে একজন ক্ষতিগ্রস্ত মিশুক মালিক সিএনজিচালিত অটোরিকশা প্রতিস্থাপন করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে শুধু ঢাকা মহানগরে চলাচলকারী মিশুক প্রতিস্থাপনের সুযোগ পাবেন তিনি। যেসব মিশুক ঢাকা থেকে অন্য জেলায় স্থানান্তরিত হয়েছে তা প্রতিস্থাপনের অনুমতি পাওয়া যাবে না। তবে মিশুক প্রতিস্থাপনের আগে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের অনুমোদিত পাঁচ সদস্যের কমিটির মাধ্যমে প্রকৃত মালিকানা যাচাই করা হবে। দেখা গেছে, প্রতিস্থাপনের সঙ্গে জড়িতরা বিধি মানেননি। ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জে স্থানান্তরিত মিশুকেরও প্রতিস্থাপন অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেনে তা করা হয়েছে।

২০০১ সালে সরকার পুরোনো বেবিট্যাক্সি বাতিল করেছিল। তা বদলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। তবে দুর্নীতি-অনিয়মের ফলে ২০০৪ সালে বেবিট্যাক্সি আমদানি বন্ধ করা হয়। ২০১৫ সালে ঢাকা মহানগরীতে পুরোনো মিশুকের পরিবর্তে প্রায় দুই হাজার অটোরিকশার অনুমোদন দেয় বিআরটিএ। অনুমোদন প্রক্রিয়ায়ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। এরপর নিবন্ধন বন্ধ হয়ে যায়। পরে মেয়াদ শেষে একই মালিকের নামে আবার নতুন অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে।

সেই মাসুদ এখন চট্টগ্রাম বিআরটিএতে : মিশুক প্রতিস্থাপনে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত মো. মাসুদ আলম বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালকের (ইঞ্জিনিয়ারিং) দায়িত্ব পেয়েছেন। গত ২৫ মার্চ তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয় পরিদর্শনে গিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সড়কমন্ত্রীর কাছে সেবাগ্রহীতারা লাইসেন্স সময়মতো না পাওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করেছিলেন। বিআরটিএ মিরপুর অফিসের উপপরিচালক মাসুদ আলম তখন সেতুমন্ত্রীর পাশেই ছিলেন। সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে অভিযোগ শুনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মাসুদকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘ভালো হয়ে যাও মাসুদ, ভালো হয়ে যাও। তোমাকে আমি অনেক সময় দিয়েছি। তুমি ভালো হয়ে যাও। তুমি কি এখানে আবার পুরোনো খেলা শুরু করেছ? তুমি কি কোনো দিনও ভালো হবে না?’ মন্ত্রীর এ বক্তব্য পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

মাসুদ আলম এর আগে ২০২২ সালের ২০ জুন বিআরটিএ খুলনা কার্যালয়ে বিভাগীয় পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। তারপর চট্টগ্রাম বিআরটিএতে যোগ দিলেন গত মাসে। মিশুক প্রতিস্থাপনের বিষয়ে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি (মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি) বরকত উল্লাহ ভুলু গত রাতে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘দেশটা কি মগের মুল্লুক হয়ে গেছে! অবৈধ কোনো লেনদেন হয়নি। যা হয়েছে বৈধভাবে হয়েছে। যেখানে যত টাকা প্রয়োজন সেখানে তত টাকা দেওয়া হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ফালতু।’

ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক (মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি) মোশারফ হোসেন গত রাতে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমি আসলে আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে কিছু জানি না। মিশুকের প্রতিস্থাপন নিয়ে হাইকোর্টে একটা রিট করা হয়েছিল। রায় আমাদের পক্ষে এসেছে। তারপর সেগুলো কার্যক্রম যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত বিআরটিএ’র তৎকালীন উপপরিচালক ও বর্তমান চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মাসুদ আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close