কাইয়ুম আহমেদ

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দেশে বাড়ছে ক্যানসার রোগী ২৬ বছরে দ্বিগুণের শঙ্কা

দেশে বর্তমানে ১২ লাখ ক্যানসারের রোগী রয়েছে। প্রতি বছর আনুমানিক দুই লাখ মানুষ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং দেড় লাখ রোগী প্রাণ হারায়। সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব এবং অর্থনৈতিক অবস্থা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ক্যানসার রোগে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির মূল কারণ। দেশেও ক্যানসার রোগী ক্রমাগত বাড়ছে এবং আগামী ২৬ বছরে (২০৫০ সাল) ২০২২ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি ক্যানসার রোগী শনাক্ত হওয়ার শঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি ১৮৫ দেশ এবং ৩৬ ধরনের ক্যানসারের তথ্যের ভিত্তিতে এ শঙ্কার কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশের বিষয়ে বলা হয়েছে, খাদ্যনালি, ঠোঁট, ওরাল ক্যাভিটি এবং ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ ?বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ক্যানসার দিবস। প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি দিবসটি পালিত হয়। ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা ও শিক্ষা প্রসারিত করাই দিবসটির লক্ষ্য।

ক্যানসার হলো এক সমষ্টিগত রোগের একটি সাধারণ নাম, যেখানে শরীরের কিছু কোষ বিভিন্ন কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। অপরিশোধিত ক্যানসার পার্শ্ববর্তী স্বাভাবিক কলার মধ্যে কিংবা শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে সাংঘাতিক অসুস্থতা, প্রতিবন্ধকতা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। গবেষণা বলছে- ক্যানসার রোগ সম্পর্কে অসচেতন হওয়ার কারণে মানুষ এই রোগটিকে গুরুত্ব দেয় না। আর চিকিৎসকরা বলছেন, পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের প্রকোপ বেশি এবং নারীদের মধ্যে স্তন ও জরায়ুর ক্যানসার সবচেয়ে বেশি।

ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে আনুমানিক ৯.৭ মিলিয়ন মানুষ ক্যানসারে মারা গেছে। ডব্লিউএইচও ১১৫টি দেশের সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা গেছে বেশির ভাগ দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের অংশ হিসেবে ক্যানসার এবং এর পরিষেবাকে পর্যাপ্তভাবে অর্থায়ন করে না। আইএআরসি এর গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরির নতুন তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী যারা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে ও মারা গেছে তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ১০ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিল।

নতুনভাবে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বব্যাপী ২.৫ মিলিয়ন, যা সবচেয়ে বেশি। এরপর ২.৩ মিলিয়ন স্তন ক্যানসার, ১.৯ মিলিয়ন কোলোরেক্টাল ক্যানসার, ১.৫ মিলিয়ন প্রোস্টেট এবং ৯ লাখ ৭০ হাজার মানুষ পাকস্থলীর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। ফুসফুসের ক্যানসারে ১.৮ মিলিয়ন, কোলোরেক্টাল ক্যানসারে ৯ লাখ, লিভার ক্যানসারে ৭ লাখ ৬০ হাজার, স্তন ক্যানসারে ৬ লাখ ৭০ হাজার এবং পাকস্থলীর ক্যানসারে ৬ লাখ ৬০ হাজার জন মারা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেরিতে ক্যানসার শনাক্ত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। ডব্লিউএইচও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে ২০৫০ সালে সারা বিশ্বে ক্যানসারে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ মিলিয়নে পৌঁছাবে, যা ২০২২ সালের সংখ্যার তুলনায় প্রায় ৭৭ শতাংশ বেশি। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) একটি সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে সংস্থাটি বলছে, প্রায় পাঁচজনের মধ্যে একজন তাদের জীবদ্দশায় ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। তা ছাড়া প্রতি ৯ জন পুরুষের মধ্যে একজন এবং ১২ জন নারীর মধ্যে একজন ক্যানসারে মারা যায়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সাবেক সভাপতি মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী বলেছেন, ভেজাল খাবার ও জাংক ফুডের ব্যবহার, অলস জীবনযাপন, দূষণ এবং তামাক ও অ্যালকোহল ব্যবহার বাংলাদেশে ক্যানসারের রোগী বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ। হাইপার অ্যাসিডিটি পুরুষ এবং নারী উভয়ের মধ্যেই সাধারণ। এ কারণেই খাদ্যনালির ক্যানসারের ঘটনা বাড়ছে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ অ্যান্ড হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক এম নিজামুল হক বলেন, দেশে ক্যানসারের পুরো চিত্র পেতে আমাদের শিগগিরই এ-সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করতে হবে। আমাদের কাছে হাসপাতালভিত্তিক কিছু তথ্য আছে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ নয়।

প্রখ্যাত ক্যানসার এপিডেমিওলজিস্ট হাবিবুল্লাহ রাসকিন বলেন, রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা যে বাড়ছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে সঠিক তথ্য ছাড়া এর পরিমাণ বলা কঠিন।

একটি জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কৌশল থাকতে হবে, যার অধীনে কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচির বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকবে জানিয়ে রাসকিন বলেন, সঠিকভাবে ক্যানসার শনাক্ত করা এবং স্ক্রিনিং সিস্টেম ও চিকিৎসা প্রোটোকল অবশ্যই থাকতে হবে। এখনই আমাদের সব ক্যানসার প্রোগ্রামকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার উপযুক্ত সময়, যাতে আমাদের কাছে সঠিক তথ্য থাকতে পারে।

সরকার গত বছর সার্ভিকাল ক্যানসারজনিত মৃত্যু দূর করার জন্য স্কুল-স্তরের এইচপিভি (হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস) টিকাদান কর্মসূচি চালু করেছে জানিয়ে হাবিবুল্লাহ রাসকিন আরো বলেন, হেপাটাইটিস বি এবং অন্য ভ্যাকসিন ক্যানসারজনিত মৃত্যু কমায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল বলেন, ক্যানসার প্রতিরোধে কিছু অভ্যাস রপ্ত করে নিতে হবে। এর মধ্যে নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক বা শারীরিক পরিশ্রম ও পরিমিত স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ অত্যাবশ্যক। নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত যৌন অভ্যাস নিশ্চিত করতে হবে। শাকসবজি, ফলমূল ও বিভিন্ন ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে। অধিক ক্যালরি, ফ্যাটযুক্ত খাবার, ধূমপান, তামাক ও মদ্যপান পরিহার করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর মানুষের বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন স্ক্রিনিং পরীক্ষা ক্যানসার প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। প্রাথমিকপর্যায়ে রোগ শনাক্ত করতে এই পরীক্ষাগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও নিয়ম অনুযায়ী ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের পাশাপাশি হেপাটাইটিস, এইচপিভির মতো ভাইরাসের টিকা বা ভ্যাকসিন নিতে হবে। এর মাধ্যমে বেশ কিছু ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিপৎসংকেত দেখামাত্র দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close