কাজী আবুল মনসুর, চবি থেকে ফিরে

  ১৫ মার্চ, ২০২৩

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা অনিশ্চয়তা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলরকে (ভিসি) বেকায়দায় ফেলে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। আগামী মে মাসে ভিসি ড. শিরীন আখতারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। নতুন অনেকে ভিসি হওয়ার দৌড়ে আছেন। দলাদলি, গোপন বৈঠক, শিক্ষকদের ওপর নানা ধরনের চাপ ইত্যাদি হয়ে উঠেছে আলোচনার বিষয়।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ১৫টি হল আর ৫০টি ডিপার্টমেন্টে চলছে শুধু পদত্যাগ ইস্যু নিয়ে আলোচনা। যেকোনো মূল্যে বর্তমান ভিসিকে ব্যর্থ ভিসির খাতায় নাম লিখিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে একটি পক্ষ ব্যস্ত। বসে নেই ভিসিও। তিনিও এখন কঠোর হাতে সব সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হচ্ছেন না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে ১৯ জন শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন। গত রবিবার ১৬ জন, সোমবার আরো তিনজন। এ ধরনের ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। কেন একসঙ্গে এত শিক্ষক প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন তা বলাবাহুল্য। তবে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে সামনে এসেছে তা হলো পদত্যাগকারী সব শিক্ষক ভিসি শিরীন আক্তারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের পদত্যাগের পর পরিস্থিতি সামাল দিতে জুনিয়র শিক্ষক দিয়ে প্রশাসনিক পদগুলো পূরণের চেষ্টা করছেন ভিসি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তাদের মধ্যে এমনও শিক্ষক রয়েছেন যার শিক্ষকতার বয়স মাত্র ৪০ দিন!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের মধ্যে চরম গ্রুপিং ও দলাদলি নজরে পড়ার মতো। ভিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে হঠাৎ করে শিক্ষকদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ হুমকির হুমকির মধ্যে পড়েছে। অনেক ক্লাস হচ্ছে না। অনেক বিভাগ সেশনজট চরম আকার ধারণ করেছে। লেখাপড়ার মানও তলানিতে। গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গেল বিসিএসসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের করুণ অবস্থা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অনেকে এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাও দিতে চান না।

বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. এ এফ এম ইমাম আলী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমি যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম এটি বলতেও এখন লজ্জা লাগে। এখানে শিক্ষকরা যে পরিমাণ দলাদলিতে লিপ্ত তা অন্য কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। তিনি বলেন, যারা এ কাজগুলো করছেন তাদের সবাইকে প্রশাসনিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ভিসিপন্থি এবং ভিসিবিরোধী যারাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনাম নষ্ট করে চলেছেন তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

ড. ইমাম আলী বলেন, ‘এখন ভিসি হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন অনেকে। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। সবার কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য, যার ভেতরে নৈতিকতা আছে, অতীতের রেকর্ড ভালো এমন ব্যক্তিকে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হলে এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থাকে ছাত্র-ছাত্রী ও দেশের জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, যাদের নিয়োগ করা হয়েছে তাদের যোগ্যতা কী, সবকিছু বের করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত আবেদন থাকবে, একটি উঁচু পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত ভিসি ড. বদিউল আলমের পর থেকে এ পর্যন্ত যে সব শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা আছে কি না যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে বের করে আনা হলে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। ড. ইফতেখার বলেন, যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক যদি নিয়োগ দেওয়া না হয়, তাহলে তারা ছাত্র-ছাত্রীদের কী শেখাবেন।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান সংকটের পেছনে যে নামটি ঘুরে ফিরে এসেছে তা হলো সাবেক প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদনের যোগ্যতা শিথিল করে তিনি তার স্ত্রীকে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভিসি শিরীন আখতার রাজি হননি। এর আগে ড. রবিউল বেশ কয়েকজন কর্মচারী নিয়োগ করতে গিয়েও বাধা পান। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার রয়েছে একটি অনুসারী গ্রুপ। তা ছাড়া কিছু ছাত্রকেও তিনি ব্যবহার করতেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।

ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. ইলিয়াস একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘প্রক্টর অফিসকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের হাওয়া ভবন বানিয়ে ফেলেছেন রবিউল স্যার। যেখানে বসে তিনি নিয়োগ, টেন্ডারের ভাগ-বাঁটোয়ারা করেছেন। ক্ষমতার জোরে তিনি ১ কোটি ১০ লাখ টাকার কাজ তুলে দিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের বর্তমান যুগ্ম সম্পাদকের হাতে। ছাত্রলীগের মধ্যে যখনই কোনো সংঘাতের আশঙ্কা হতো, তখনই আমরা রবিউল স্যারকে জানাতাম। তাকে বলতাম, দুই পক্ষকেই মারামারির আগেই যেন ডাকায়। তিনি তা না করে সংঘাত লাগানোর পরিবেশে আরো ঘি ঢালতেন। পরে উপাচার্যকে গিয়ে বলতেন, নিয়োগ দিতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া যদি আমরা নিয়ন্ত্রণে না করি ক্যাম্পাসে প্রতিদিন মারামারি হবে। এভাবে তিনি নিয়োগ, টেন্ডার হাতিয়ে নিয়েছেন। আমরা অনেক আগে থেকে এসব নিয়ে ফেসবুকে লিখেছি। এত দিন পর হলেও এই হাওয়া ভবনের আস্ফালন বন্ধ হবে। আশা করি নতুন প্রক্টর সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকবেন।’

সূত্র জানায়, প্রক্টর রবিউলের নানা কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ ভিসি শিরীন আক্তার। তিনি গত ৯ মার্চ তাকে ডেকে পদত্যাগ করতে বলেন। একই সঙ্গে তার সমর্থকদের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে বলেন। ভিসির কথায় গত ১২ ও ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর পদ থেকে প্রফেসর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়াসহ ১৯ জন পদত্যাগ করেন।

ড. রবিউল হাসান তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অভিযোগগুলো মনগড়া এবং ভিত্তিহীন। একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মের ভেতরে চলে। ভিসিকেও নিয়মের মধ্যে চলতে হবে। কোনো ব্যক্তি স্বার্থ প্রাধান্য দেওয়া ভিসির কাজ না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীন আখতার বলেন, ‘প্রক্টরের কী কাজ। যারা পদত্যাগ করেছেন তারা কী কেউ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত কয়েক মাস ধরে তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি। আমি বুঝতে পেরেছি প্রক্টর অফিসে বসে তারা অনেকটা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছেন। অনেককে বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিয়ে ভুল করেছি। অনিয়ম করছে তারা, বদনাম হচ্ছে আমার। এ অবস্থায় তাদের ডেকে পদত্যাগ করতে বলেছি। তাদের জায়গায় নতুনদের প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। কোনো প্রকার চাপের মুখে আমি নতি স্বীকার করব না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ‘বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যা চলছে তা সত্যিই দুঃখজনক। ভিসি ড. শিরীন আখতার দায়িত্ব নেওয়ার পর বড় বড় প্রশাসনিক পদগুলোতে যাদের বসিয়েছেন তারাই একসময় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু ভিসি তার ডিপার্টমেন্টে বা সিন্ডিকেটে অতীতে কোনো দায়িত্ব পালন করেননি, তাই ১৫টি হল আর প্রায় ৯০০ শিক্ষককে সামলানোর যে কৌশল তা জানতেন না। তিনি অনেকটা সহজভাবে বিষয়গুলো নিয়েছেন। এগুলো যে পরে জটিল আকার ধারণ করতে পারে তিনি কোনো দিন কল্পনাও করেননি। তিনি যাদের বসিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকে তার অগোচরে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজিও করে চলেছেন। কোনো সমস্যা হলে আমরা সামলে নেব- এমন কথা বলে ভিসিকে মিসগাইড করেছেন। নিজেরা ভিসিকে ব্যবহার করে শক্তিশালী হয়েছেন। পরে কোনো সমস্যা হলে সব দোষ গিয়ে পড়ে ভিসির ঘাড়ে। বর্তমান পরিস্থিতি তারই বহিঃপ্রকাশ।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। এই প্রতিবেদককে সম্মিলিতভাবে তারা বলেন, ‘আমরা চাই না আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টির সুনাম নষ্ট হোক। গুটি কয়েকজন শিক্ষকের কারণে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা হুমকির মুখে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একটি ব্যর্থ শিক্ষাঙ্গনে রূপ নেবে। শিক্ষার্থীরা চাইছে অবিলম্বে এ অচলাবস্থার অবসান হোক। প্রয়োজনে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিন।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close