গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৮ জুন, ২০২২

করোনা সংক্রমণ বাড়ায় উদ্বেগ বিশেষজ্ঞদের

নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ বৃদ্ধিকে উদ্বেগজনক ও চিন্তার কারণ আখ্যা দিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা নিয়ন্ত্রণে রাখার একটাই পথ কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা। পাশাপাশি মাস্ক পরা ও জনসমাগম এড়িয়ে চলায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা। তারা বলছেন, দুই বছর ধরে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানায় যে ধরনের কৌশল নেওয়া হয়েছিল, সেখানে পরিবর্তন আনতে হবে। এমন নতুন কৌশল নেওয়া যেটা দেখে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানায় উদ্বুদ্ধ হয়। আর শক্তিশালী কোভিড ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ও ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টগুলো জ্যামিতিকভাবে পরিবর্তন হয়ে নতুন ভ্যারিয়েন্ট প্রকাশ পেয়েছে বি-৪ ও বি-৫। ভাইরাসটি বেঁচে থাকার জন্য নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসাটি স্বাভাবিক। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। এদিকে গত রবিবারের পর গতকালও দুজন মারা গেছেন। আর এদিন শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ১০১ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। দেশে করোনায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ১৪২ জনে। এছাড়াও মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ২৭৪ জনে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত এক দিনে ঘণ্টায় করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ১৭৯ জন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৯ লাখ ৬ হাজার ৮৬৭ জন। ২৪ ঘণ্টায় ১৩ হাজার ৯২০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয় ১৩ হাজার ৮২০টি নমুনা। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে প্রতিদিন বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে আরো বাড়তে পারে এর সংক্রমণ। টিকা ডোজের সক্ষমতা সর্বোচ্চ থাকে ছয় মাস। এ সময় অতিক্রম করাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি দেশেও প্রতিদিন বাড়ছে করোনা সংক্রমণ, যাকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন উদ্বেগজনক। বর্তমানে ৯ হাজারের মতো করোনা রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করার মাধ্যমে এখনই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে আগামী দুই সপ্তাহ অর্থাৎ ১৪ দিন পর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে পারে। করোনা বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সরকারের করোনাবিষয়ক কারিগরি কমিটির অন্যতম সদস্য ও জনস্বাস্থ্য ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, কোভিড বেড়ে যাওয়াটা আমার কাছে খুব বেশি অযৌক্তিক মনে হয় না। কারণ করোনা একটা রেসক্রুটি ভাইরাস। যেকোনো ভাইরাসই একটা ফ্লু (ফিবার)। এই ফাইবার ফিবারের লক্ষণটা সিজনাল। এতে অডিট টেম্পারেচার ও হিউমিনিটি বেড়ে যায়।

বলেন, দেখেন দেশে গত ৩ মাস আগেও ফাইবার ফিবারও ছিল না। এখন নন-কোভিড ফিবারও আছে প্রচুর পরিমাণে। একইভাবে বলা যায়, করোনা সিজনাল ভ্যারিয়েন্ট হবে- এটাই স্বাভাবিক। এ ধরনের লক্ষণগুলো ইনফেকটিভ ডিজিজের কার্ভ বলে। একবার নিচের দিকে নামে; আবার ওপরে ওঠে। কখনো ডেডলাইনে পৌঁছে যায়। কিন্তু যখনই সিজনাল ভ্যারিয়েন্টের কারণে তাদের পরিবর্তন করে পরিবেশের সঙ্গে তার সারভাইভেলের ক্যাপাসিটি বাড়িয়ে দেয় এবং তখন ভ্যারিয়েন্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং এ সময়ে নতুন নতুন ব্যক্তিকে আক্রমণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। যার ফলে আপনার আনডাউডলি, ডেল্টা ও ওমিক্রম ভ্যারিয়েন্টের পর এখন সাব-ভ্যারিয়েন্ট বের হচ্ছে। তবে এগুলোর এখনো শারীরিক সক্ষমতা তৈরি হয়নি- এটা মনে রাখতে হবে। একইভাবে আমরা যে ভ্যাকসিন দিয়েছি ভ্যাকসিনগুলো শতভাগ সব ভ্যারিয়েন্টের পক্ষে কাজ করছে না। কারণ বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন দিয়েছি, সেগুলো শারীরিক সক্ষমতা তৈরির জন্য ছয় মাস সময় থাকে। যারা টিকা নিয়ে এবং বুস্টার ডোজ নিয়েছে তাদেরও কিন্তু ডিজায়ার্ড লেভেলে অ্যান্ট্রিবডি নেই। আর নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিপক্ষে আগের দেওয়া ভ্যাকসিনগুলো শতভাগ কার্যকরী না। ভাইরাসগুলো এমনই করে; যার পরিবেশের সঙ্গে তার নিজের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই তার বংশ বৃদ্ধি করাটার কারণেই ভাইরাস পরিবর্তিত হয়। জ্যামিতিক চেঞ্জগুলোর কারণে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হচ্ছে, আর হওয়াটা স্বাভাবিক। তার বেঁচে থাকার জন্য এই ভ্যারিয়েন্টটা স্বাভাবিক।

বলেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো তুলনামূলকভাবে মেডিকেল কনডিশন আগের মতো তৈরি করতে পারবে না। জ্বর, হাঁচি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট হতো এবং মাথা ঘুরাতো এই সমস্যাগুলো তুলনামূলকভাবে কম হবে। কোভিড সংক্রমণ ১৫ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। কিন্তু ক্রিটিক্যাল রোগ তৈরির ক্ষেত্রে নতুন ভ্যারিয়েন্টের সক্ষমতা কম। এটাকে মডালিটি বলে। মৃত্যুর সংখ্যাও কম। সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যাও কম।

তিনি বলেন, বর্তমানে যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে, এভাবে চলতে থাকবে না। ব্যাপকভাবে যখন ছড়িয়ে পড়বে তখন প্রাকৃতিকভাবে একটা হার্ড ইউমিউনিটি তৈরি হবে। এরপর আস্তে আস্তে আবার সংক্রমণ কমে আসবে। তবে কোভিড যাতে সামাজিকভাবে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া সমীচীন না। এজন্য মাস্কপরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ কোভিড প্রতিরোধে সচেতন হওয়া জরুরি। এ ছাড়া শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বেশি বেশি পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খাওয়া এবং ভিটামিন-সি জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী প্রতিদিনের সংবাদকে এ প্রসঙ্গে বলেন, এই জাতীয় ভাইরাস ডিজিজগুলো অনেকটা ঢেউয়ের মতো আসে; অর্থাৎ এটা শুরু হয়ে চূড়ায় পৌঁছে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসে। ফের কিছু দিন থেকে আবার বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে যে কোভিড সংক্রমণ শুরু হয়েছে, এটাকে দেশে করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ হিসেবে অভিহিত করা যায়।

বলেন, ভারতে যখন করোনা সংক্রমণ বেড়েছিল, আমরা আশঙ্কা করেছিলাম আবার দেশেও এটা বাড়বে। বাড়ছে শুধু তাই না; ভারতে যে নতুন ওমিক্রমের মিশ্র ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে বি-৪। এ ধরন যশোরেও পাওয়া গেছে। এটা আশঙ্কার কথা। এর বাইরে বি-৫ ভ্যারিয়েন্টটিও পাওয়া যাচ্ছে। বি-৪ ও বি-৫ দুটিই অতিমাত্রায় সংক্রমণশীল। একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে খুব দ্রুতই বহুজনে ছড়িয়ে যায়। এটার কারণেই প্রতিদিন করোনার সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তবে নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণে যে রোগ হচ্ছে তা আগের মতোই শক্তিশালী না। ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ কোভিড লক্ষণ থাকার পরও পরীক্ষা করছে না; কারণ তাদের আক্রমণটা তীব্র না। তাই হাসপাতালেও ভর্তি রোগীর সংখ্যা কম।

তিনি বলেন, যদি কোভিড লক্ষণ ও উপসর্গ রয়েছে সবাই পরীক্ষা করত তাহলে সম্ভাবত প্রতিদিন ১০-১২ হাজার রোগী শনাক্ত হতো। বর্তমানে ১৫ শতাংশের বেশি শনাক্ত হওয়ার পরও হাসপাতালে রোগী ভর্তি না হওয়ার কারণে বাইরে চাপও কম দেখতে পারছি। এখন এটা প্রতিরোধ করতে গেলে দুটি পথ অবলম্বন করতে হবে। করোনাকে থামানোর জন্য শরীরের মধ্যে সুরক্ষা ক্ষমতা তৈরি করতে হবে এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে যারা টিকা নেননি দ্রুত টিকা নেওয়া সম্পন্ন করা।

করোনা আরো বাড়ানোর আশঙ্কার কথা জানিয়ে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহার কারণে মানুষ প্রচুর বাড়ি যাবে, আবার ফিরে আসবে। এর মাধ্যমে সারা দেশে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই অবস্থায় মাস্কপরা ও স্বাস্থ্যবিধির ওপরে জোর দিতে হবে। বলেন, গত দুই থেকে আড়াই বছরে করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার যে ধরনের সচেতনতামূলক কৌশল নিয়েছে সেখানে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কারণ এমন কৌশল নেওয়া প্রয়োজন যাতে মানুষ সচেতন হতে সহায়ক হয়।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশে বাড়ার কারণ হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মানায় কিছুটা ত্রুটি ছিল। আর বিভিন্ন দেশে এটা বাড়ছে; যার প্রভাব পড়েছে এখানে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমানসংখ্যক টিকা দেয়নি। টিকা না দেওয়ার একটা প্রভাব আছে। দেখা গেছে, যেসব দেশে টিকা কম দেওয়া হয়েছে সেখানে করোনা বেশি বাড়ছে। আর বেশি আক্রান্ত হলে মানুষ যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানে তাহলেই অনেকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণ বেড়েছে, মানুষ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে আবার আসছে। কিন্তু কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। অভ্যন্তরীণ ভ্রমণে যানবহন থেকে শুরু করে সভা-সমাবেশে কোথাও আমরা মাস্ক পরি না। বাড়ার এটাও একটা কারণ আছে।

তিনি বলেন, শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (সাইট সিমটম) নেই। অথচ আপনি করোনা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আপনি মাস্ক পরছেন না, উল্টো করোনা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। দেশের করোনা বৃদ্ধির এগুলোও কারণ। বলেন, রবিবার সাড়ে ১৫ শতাংশ সংক্রমণ ছিল; এটা আরো বাড়তে পারে। তবে বিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকার কারণে মানুষ এক ধরনের স্বস্তিতে আছে। মনে করছে, আক্রান্ত হচ্ছেন কিন্তু মারা তো যাচ্ছে না। গত ৭ থেকে ৮ দিনে সাত হাজারের মতো রোগী বাংলাদেশে আছে। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সুতারং এর মধ্যে আগামী সপ্তাহে রোগী মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। তাই আপাতত দৃষ্টিতে নিরাপদ মনে হলেও ব্যাপারটা মোটেও নিরাপদ না। এটা খুবই উদ্বেগজনক। আমরা চিন্তিত। কিন্তু মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে; এর বিকল্প নেই। যানবাহন, জনসমাবেশ এবং ইনডোর সভায় স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close