আহমেদ জামিল, সিলেট

  ২১ জুন, ২০২২

প্রধানমন্ত্রীর কাছে বন্যার স্থায়ী সমাধান প্রত্যাশা

আজ মঙ্গলবার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকালে হেলিকাপ্টারযোগে সিলেট এসে পৌঁছাবেন তিনি। এরপর হেলিকপ্টার দিয়েই তিনি সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করবেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর আগমনের খবরে বন্যাদুর্গতরা আশায় বুক বাঁধছেন। তাদের আশা- মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ দেখে প্রধানমন্ত্রী শুধু সহযোগিতার হাতই বাড়াবেন না, সিলেট অঞ্চলকে অকালবন্যার হাত থেকে বাঁচাতে স্থায়ী পদক্ষেপ হিসেবে ‘বিশেষ বার্তা’ দিয়ে যাবেন। এ ছাড়া বানের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ ও ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন তারা।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী সকাল ৮টায় হেলিকাপ্টারযোগে ঢাকা থেকে রওনা দেবেন। হেলিকাপ্টার থেকে নেত্রকোনার বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরে এসে অবতরণ

করবেন। এরপর আসবেন সিলেট সার্কিট হাউসে। সেখানে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে যেতে পারেন।

বছরে অন্তত চার থেকে পাঁচবার আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয় সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলা। বন্যার ভরা মৌসুম ছাড়াও গোয়াইন, সারি ও পিয়ান নদী হয়ে নেমে আসা উজানের ঢলে এসব এলাকায় অকালবন্যা দেখা দেয়। অন্যদিকে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়লেই তলিয়ে যায় জকিগঞ্জ-কানাইঘাট উপজেলাসহ সিলেটের বেশ কটি উপজেলা। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে অল্প বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় তলিয়ে যায় সিলেট নগরী। সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয় মানুষজনকে।

সর্বশেষ টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সব কটি নদ-নদীত পানি বেড়ে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত। সুরমা নদীর পানি উপচে গত শুক্রবার থেকে পানির নিচে সিলেট নগরী।

কেন এত বন্যা? কেন অল্পতেই তলিয়ে যায় নগরসহ গ্রামাঞ্চল? সে প্রশ্ন সিলেটের অর্ধকোটি পানিবন্দি মানুষের। পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেটের প্রতিটি নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা ও সøুইসগেট নির্মাণ, নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়-টিলা। মূলত, ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির জন্য এসব কারণই দায়ী।

ত্রাণের জন্য হাহাকার : স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের বন্যাদুর্গতরা ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। ত্রাণের গাড়ি দেখলেই রাস্তায় এসে ভিড় করছেন শত শত মানুষ। তাদের অভিযোগ, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি পর্যাপ্ত ত্রাণ দিলেও সরকারিভাবে তেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন না।

গোয়াইনঘাট উপজেলার মিত্রিমহল এলাকার বশির কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নেওয়া কমলা বেগম নামের এক বৃদ্ধ বলেন, ‘যারা ত্রাণ নিয়ে আসে তারা ২০-২৫ প্যাকেট বিতরণ করেই চলে যায়। যারা শক্তিশালী তারা ধাক্কাধাক্কি করে সব নিয়ে যায়। আমি বৃদ্ধ মানুষ ভিড়ের মধ্যে যেতে পারি না।’

ত্রাণের জন্য রাস্তায় আসা কোম্পানীগঞ্জের গৌরনগর গ্রামের জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের আর কিছুই রইল না। কখনো কারো কাছে হাত পাতিনি। আর এখন ত্রাণ না পেলে না খেয়ে মরতে হবে।’

নগর এখনো পানির নিচে, দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত : সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নগরীর নিচু এলাকার বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাট পানির নিচে। নগরীর উপশহর তালতলা, তেররতন, ঘাসিটুলা, শামীমাবাদসহ বেশ কিছু এলাকায় এখনো কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি। দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, গত রবিবার সন্ধ্যা থেকে সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার ও সিলেট (নগরী) পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার কমেছে। একই সময় কুশিয়ারা নদীর পানি শেরপুর পয়েন্টে কমলেও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার বেড়েছে। অবশ্য সারি ও লোভাছড়া নদীর পানি কমেছে। সোমবার সকাল ১১টার দিকে সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমার দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার ও কানাইঘাটে ১ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর অমলসিদ পয়েন্টে ১ দশমিক ৮৪ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে বিপৎসীমার দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার ও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার দশমিক ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

সিলেটে পাউবোর বিভাগীয় উপসহকারী প্রকৌশলী এ কে এম নিলয় পাশা জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ার কারণে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কিছু এলাকা নতুন করে প্লাবিত হতে পারে। এ ছাড়া গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সদর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জে প্লাবিত এলাকার পানি ধীরে ধীরে কমছে বলে জানান তিনি।

এখনই সচল হচ্ছে না ওসমানী বিমানবন্দর : রানওয়ে থেকে পানি নামলেও অ্যাপ্রোচ লাইট তলিয়ে থাকায় এখনই সচল হচ্ছে না সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। গতকাল সোমবার সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দর পরিদর্শনে তিনি এ কথা বলেন।

প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, ‘আমরা যত দ্রুত সম্ভব এই বিমানবন্দর চালু করার চেষ্টা করব। তবে পানি না নামলে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। সরকার ও আওয়ামী লীগ মিলে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বন্যাদুর্গতদের জন্য কাজ করছে। এসব দুর্যোগ-দুর্বিপাক সঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হবে।

১৪০ কোটি টাকার মৎস সম্পদের ক্ষতি : মৎস্য অধিদপ্তরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, চলমান বন্যায় সিলেটে মাছ চাষে ১৪০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। সুনামগঞ্জের খামারিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রায় ৩২ হাজার ৮০২ জন খামারি ৫ হাজার ২৫৮ হেক্টর জমিতে কার্পজাতীয় মাছের চাষ করছিলেন। আকস্মিক বন্যায় তাদের আর্থিক লাভের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

সিলেটে মৎস্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপপরিচালক ড. মো. মোতালেব হোসেন বলেন, এটি একটি প্রাথমিক প্রাক্কলন। খামারিদের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে। কারণ সুনামগঞ্জের প্রায় সব খামারই পানিতে ভেসে গেছে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস : শিগগিরই বৃষ্টি কমার সম্ভাবনা নেই। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় মাসজুড়ে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট আবহাওয়া অফিস। সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, আজ মঙ্গলবার সিলেটে বৃষ্টি কিছুটা কমতে পারে। আসাম ও মেঘালয়ে বন্যা হচ্ছে। ফলে উজানে বন্যা ও অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে সামগ্রিক পরিস্থিতি খারাপ। সিলেটে ২৯ জুন পর্যন্ত মাঝামাঝি ধরনের ভারী বৃষ্টি থেকে অতি ভারী বৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে।

ঝুঁকিমুক্ত কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্র : সিলেট নগরী থেকে বন্যার পানি তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট থেকে জাতীয় গ্রিড লাইনের কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্র ঝুঁকিমুক্ত বলে জানিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। গতকাল সোমবার বিকালে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি।

এ সময় সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বন্যার এই বিপদে যদি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেত তবে আমরা নগরবাসী আরেকটি মহাসংকটের মধ্যে পড়ে যেতাম। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ত। কেউ কারো কোনো খোঁজ নিতে পারতাম না। দুর্ভোগ বেড়ে যেত। এজন্য তিনি জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিদ্যুৎ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।’

বড়লেখায় ২০০ গ্রাম প্লাবিত, দুজনের মৃত্যু : মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ২০০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পৌর শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পানি উঠেছে। উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বড়লেখা পৌরসভার মেয়র আবুল ইমাম মো. কামরান চৌধুরী বলেন, শহরের প্রায় আড়াই হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

হবিগঞ্জে বাড়ছে খোয়াই নদীর পানি : হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানি বাল্লা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২৭ সেন্টিমিটার ও মাছুলিয়া পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। নবীগঞ্জ ও আজমিরীগঞ্জের পর এবার লাখাই উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (অ. দা.) মিনহাজ আহমেদ শোভন জানান, কুশিয়ারার পানি বাড়ছে। বাঁধ উপচে পানি হাওরে প্রবেশ করায় নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে।

জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে নবীগঞ্জ ও আজমিরীগঞ্জের পাশাপাশি এখন লাখাই ও বানিয়াচং উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। বন্যাকবলিত মানুষের আশ্রয়ের জন্য নবীগঞ্জে ১৩, লাখাইয়ে ১৫, আজমিরীগঞ্জে ২১ ও বানিয়াচং মিলে ৯৩ আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে ৮ হাজারেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close