নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৯ মে, ২০২২

বাড়ছে দাবদাহ

ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য কৃষি উৎপাদন

ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষকে সহ্য ক্ষমতার পরীক্ষায় ফেলে দেওয়া তীব্র তাপদাহ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে দিচ্ছে থার্মোমিটারের পারদ; জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এক সংকট জনস্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনকে ফেলছে ঝুঁকিতে। কয়েক দশকের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রীষ্মে তাপপ্রবাহের মতি গতিও বদলাচ্ছে, সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে এর প্রভাবের এলাকা, বাড়ছে ‘হটস্পটের’ বিস্তার।

আবহাওয়াবিদ ড. আবদুল মান্নানের ভাষায়, গরমের মৌসুমের শুরুতে তাপপ্রবাহ বা হিটওয়েভ এখন আবহাওয়ার ‘গুরুত্বপূর্ণ হ্যাজার্ড’ হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একই জায়গায় একই প্যাটার্নে আর এটা থাকছে না। প্রতি বছর আমরা বদলাতে দেখছি। এই যেমন দুই বছর ধরে দক্ষিণাঞ্চলের রাঙামাটি পর্যন্ত হিটওয়েভের আওতায় চলে আসছে। আগে এটা ছিল না। এখন মার্চ আর এপ্রিলে তাপপ্রবাহের ধরনে ভিন্নতা থাকছে। তাপমাত্রা তো ক্রমাগত বাড়ছে, হিটওয়েভপ্রবণ এলাকাও বাড়বে।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো এলাকার তাপমাত্রা দৈনিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে এবং টানা পাঁচ দিন তা অব্যাহত থাকবে সেখানে তাপপ্রবাহ বা হিটওয়েভ চলছে বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে দেশ ও অঞ্চলভেদে ওই মাত্রায় ভিন্নতা থাকতে পারে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে গেলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলে।

এ বছর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে খুলনা, রাজশাহী, ঢাকা বিভাগ এবং আশপাশের এলাকায় মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। এরপর বজ্রঝড় ও বৃষ্টিতে কয়েক দিনের স্বস্তি মিললেও এপ্রিলের শেষভাগে সপ্তাহজুড়ে মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ চলে।

গরমের ভরা মৌসুমে এবার রাজশাহীতে দুই দফা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছিল। এপ্রিলের ৩০ দিনের মধ্যে অন্তত ১১ দিন বিস্তীর্ণ এলাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৬ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে।

১৯৮১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশের কোথায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কেমন ছিল তার একটি ধারণা পাওয়া যায় ‘স্টাডি অন হিটওয়েভস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড লার্জ-স্কেল সার্কুলেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায়।

এ গবেষণাপত্রের সহ-লেখক মোহন কুমার দাশ জানান, ১৯৯৫ সালে চুয়াডাঙ্গা ও ঈশ্বরদীতে ৬২ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে।

২০১০ সালে যশোরে ৬০ দিন, ১৯৯৪ সালে রাজশাহীতে ৫৫ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছিল। আর এমন তাপমাত্রা ২০১৪ সালে রাজশাহীতে ছিল ৭৯ দিন, মোংলায় ৫১ দিন এবং খুলনায় ৫০ দিন।

আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, এমনিতে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমাদের দেশের পশ্চিমাঞ্চল সাধারণভাবে তাপপ্রবাহপ্রবণ এলাকা। এর সঙ্গে অ্যাটমোস্পেরিক কন্ডিশনের কারণে আরো কিছু এলাকা তাপপ্রবাহের আওতায় পড়ে যায়। ইদানীং আমরা দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলও থাকছে তাপপ্রবাহের এলাকার আওতায়। গত বছর রাঙামাটিও এর মধ্যে পড়ে গেছে। আগে রংপুর অঞ্চল তাপপ্রবাহের দাপট থাকত বেশি। এখন সেখানে ধীরে ধীরে কমে আসছে। এ বছরও রংপুরে তাপমাত্রা ততটা চড়েনি।

ফসলের ক্ষতি কমবে কীভাবে : নিউমেরিক্যাল ওয়েদার প্রেডিকশন মডেলিং ও মেটিরিওলজি গবেষক ড. মোহন কুমার দাশ মনে করেন, বন্যার মতোই হিটওয়েভ ধীরে ধীরে দুঃশ্চিন্তার বড় কারণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশের জন্য।

গবেষণায় আমরা দেখেছি, ঢাকাসহ দেশের মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন স্পট এখন হিটওয়েভের আওতায় রয়েছে। মানুষ, কৃষি ও প্রাণিকুল সবচেয়ে বেশি ভুগছে। হিটওয়েভের জন্য অ্যালার্ট করার পাশাপাশি সরকারি-সেরকারি উদ্যোগে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, বৃক্ষরোপণ বাড়ানো ও ছায়াশীতল বিশ্রামের ব্যবস্থাসহ কিছু উদ্যোগও লাগবে।

ধানের জন্য ‘ক্রিটিক্যাল টেম্পেরেচার’ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এপ্রিল-মে (বৈশাখণ্ডজ্যৈষ্ঠ) মাসে চরম গরমে ধানের জন্য ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা অসহনীয়।

ফুল ফোটার সময় ১-২ ঘণ্টা এ তাপমাত্রা বিরাজ করলে ধান চিটা হয়ে যায়। গত বছর এপ্রিলে এমন আবহাওয়ায় হাওর অঞ্চলে ‘হিটশকে’ প্রায় অর্ধলাখ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রোমেটিরিওলোজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম আরিফ হাসান খান রবিন বলেন, আবহাওয়ার বিরূপ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে উচ্চ তাপমাত্রাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের কাজ চলছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নতুন জাত আনা সম্ভব হবে।

তিনি জানান, ধানের ফুল ফোটার সময়ে যখন তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকে, তখন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ধানের ফলন। তাই কৃষককে জানতে হবে কখন তাপপ্রবাহ আসবে। ধানে ফুল আসার সময়ে তাপপ্রবাহ হলে বিশেষ স্প্রে ব্যবহার করে ক্ষতি কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর জানান, উচ্চ তাপমাত্রা সহিষ্ণু একটি ধানের জাতের আঞ্চলিক ফলন পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। ফলন ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য গ্রহণযোগ্য হলে সেটিকে জাত হিসেবে অনুমোদনের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ডে আবেদন করা হবে। গবেষণা সফল হলে তাপমাত্রার ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাতেও এ জাতের ধানের ফুল ফোটায় এবং ফলনে সমস্যা হবে না।

জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি : তাপদাহে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় শ্রমিক শ্রেণির মানুষকে। সে বিষয়টি মাথায় রেখে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং বিভিন্ন স্থানে ছায়ার ব্যবস্থা করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, তীব্র গরমে বাইরে বের হলে অনেকের হিট স্ট্রোক হতে পারে। দীর্ঘসময় তীব্র রোদে থাকলে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে গিয়ে জ্বরের মতো তাপমাত্রা বেড়ে যায়। একই সঙ্গে অতিরিক্ত ঘামের মধ্য দিয়ে শরীর থেকে লবণ ও পানি বেরিয়ে যায়। তাতে পানিশূন্যতা ও লবণশূন্যতায় শরীরে ইলেকট্রোলাইটসের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ওই অবস্থায় মানুষ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং হিটস্ট্রোক ঘটে। শিশু ও বয়স্ক, যারা বড় কোনো রোগে আক্রান্ত বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা এ ধরনের সমস্যায় পড়ার ঝুঁকি বেশি।

হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক লেলিন চৌধুরী বলেন, শরীরে পানিশূন্যতা যদি বেশি হয় এবং লবণের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, তখন দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এ সময় ভাইরাস জাতীয় অসুখের প্রবণতা, ডায়রিয়া ও ফুড পয়জনিং বাড়তে থাকে। হিটস্ট্রোক এড়াতে বাইরে বের হলে ছাতা ব্যবহার করতে হবে। যতটা সম্ভব রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। বেশি গরম পড়লে অসুস্থ যারা আছেন, তাদের বাইরে না বের হওয়াই ভালো। এ সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি অর্থাৎ দৈনিক আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পান করতে হবে। বাইরে গেলে নিরাপদ পানি পান করতে হবে; সেই সঙ্গে যত্রতত্র খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close