গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৫ অক্টোবর, ২০২১

প্রতিশ্রুতি ভাঙছে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো

নির্বাচনী আইন ও বিধি যুগোপযোগী এবং সংস্কারের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক সংলাপ আয়োজন করেছিল বিগত এটিএম শামসুল হুদার কমিশন। সব দলই সেখানে অংশ নিয়েছিল। সংলাপে বসে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি স্বপ্রণোদিত হয়ে নির্বাচনী আইনে অন্তর্ভুক্তির জন্য স্পর্শকাতর কিছু সুপারিশ করেছিল নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। সব দলের অভিন্ন একটি সুপারিশ ছিল দলে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করা।

দলগুলোর সেই অঙ্গীকার প্রায় এক যুগ আগের। সময়ের পরিক্রমায় নিজেদের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে দলগুলো ফাঁদে আটকে গেছে; যার প্রভাব পড়েছে ইসির ওপরে। নির্বাচন কমিশন বলছে, নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিজেরাই ভাঙছে রাজনৈতিক দলগুলো। ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আইনে সংশোধনী আনতে হচ্ছে ইসিকে।

এদিকে, বর্তমান কে এম নুরুল হুদার কমিশনের শুরু হয়েছে বিদায়ের ক্ষণগণনা। শেষ মুহূর্তে এসে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও), ১৯৭২ সংশোধনী আনতে কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। আরপিওতে আটটি অনুচ্ছেদে সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজন ও সংস্কারের লক্ষ্যে খসড়া প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করতে আজ সোমবার কমিশন সভা আহ্বান করা হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে।

স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগকে বাঁকা চোখে দেখছেন খোদ ইসির কর্মকর্তারা। বলছেন, বিদায়ের ঠিক আগে এ ধরনের কর্মযজ্ঞ হাতে নেওয়ার অর্থ প্রতিষ্ঠানকে খেলো প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। কারণ বিগত কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) আধুনিকায়নসহ আরপিও সংস্কারের উদ্যোগ ভেস্তে গিয়েছিল ক্ষমতার শেষ সময়ে এসে পরিকল্পনা হাতে নেওয়ায়। তাদের উদ্যোগটি খসড়া প্রস্তাবনার লাল ফিতায় আটকে ছিল। আগামী বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি এ কমিশনের মেয়াদ পূর্ণ হবে। বিগত কমিশনের মতো বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্তদের শেষ সময়ের এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন বড় ধাক্কা খাবে বলেই ধরে নিয়েছেন ইসির কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

ইসির খসড়া প্রস্তাবনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আরপিওর ৮টি অনুচ্ছেদে সংযোজন-বিয়োজন এবং সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে নির্বাচন পরিচালনার জন্য সৃষ্ট জটিলতা ও সংকট প্রতিশ্রুতি ভাঙছে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো

দূর করা সংক্রান্ত সুপারিশ আছে ইসির নতুন এ প্রস্তাবে।

আরপিওর ৭(৫) অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে বলা হচ্ছে-জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রতিটি জেলায় একজন রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালনের বিধান রয়েছে। তবে আয়তন, জনসংখ্যা ও ভোটার বিবেচনায় নির্বাচন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য কোনো জেলায় একাধিক (দুজন) রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করে কমিশন। তবে দেখা যায়, দ্বিতীয় নিয়োগপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসারের নির্বাচন পরিচালনা তদারকির সুযোগ থাকে না। তাই রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক জেলা বা নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নির্বাচনী কাজ তদারকির দায়িত্ব পালনের বিধান করার প্রস্তাব করা হচ্ছে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে।

১২(১)(১) অনুচ্ছেদে বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিলের ৭ দিন আগে ঋণ পরিশোধের প্রস্তাবের পরিবর্তে আরপিওর ১২.(১)(এম)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মনোনয়নপত্র দাখিলের পূর্ব দিন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সুযোগ রাখা হচ্ছে। একইভাবে ১২(১)(এন) অনুচ্ছেদে বিল খেলাপিরাও মনোনয়নপত্র দাখিলের পূর্ব দিন পর্যন্ত বকেয়া বিল পরিশোধের সুযোগ পাবেন, সংশোধিত প্রস্তাবে এ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ১২(৩এ)(সি) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার লক্ষ্যে ১২ ডিজিটের টিআইএনের সনদের কপি দাখিল বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যে আইনে নতুন বিধান অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এ প্রস্তাব করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতীত স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচনে ১২ ডিজিটের টিআইএন-এর সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

১৫(২) বিদ্যমান ব্যবস্থায় কেবল মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ ছিল বা আছে। এ ব্যবস্থার পাশাপাশি মনোনয়নপত্র গ্রহণের বিরুদ্ধেও আপিলের সুযোগ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন সংযোজিত আইনে। উল্লেখ্য, স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচনে মনোনয়নপত্র গ্রহণের বিরুদ্ধেও আপিলের সুযোগ রয়েছে। ২৭(১) অনুচ্ছেদে সংশোধনীর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পোস্টাল ব্যালটের পাশাপাশি অনলাইনে ভোট প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ভোটারদের ভোটদানের সুবিধার্থে আরপিওর অনুচ্ছেদ ২৭(১)(ডি) নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে অনলাইন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদানের পদ্ধতি বিধি দ্বারা নির্ধারণের লক্ষ্যে ২৭(৫) নতুন অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। দলে নারী নেতৃত্ব ৩৩ শতাংশ গত ২০২০ সালের মধ্যে পূরণ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকার করলেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় ওই নেতৃত্ব পূরণের জন্য আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে আরপিওতে সংশোধনী আনছে ইসি। আর ৯০ডি অনুচ্ছেদে বিশেষ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে ‘নবম সংসদ বসিবার ১২ মাসের মধ্যে’ আরপিওতে উল্লেখ আছে। বর্তমানে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বহাল আছে। তাই নিবন্ধনের জন্য সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় বিবেচনায় ১২ মাস সময়ের পরিবর্তে ৩০ দিনের প্রস্তাব করে অনুচ্ছেদ ৯০(ডি)-এর শতাংশে সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

জানতে চাইলে ইসির এক পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজনৈতিকগুলো সংলাপে বসে দেওয়া অঙ্গীকার লঙ্ঘন করছে। নারী নেতৃত্ব ৩৩ শতাংশ দলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গত ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় নিলেও তা পূরণ করেনি; তাই সময় বাড়িয়ে ২০৩০ সাল করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ ছাড়া আরো কিছু সংশোধনী আনার জন্য কমিশনের বিদায়ের আগে আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সোমবার মিটিং হবে।

এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো মুখে নারী নেতৃত্ব মানলেও দলে তাদের স্থান দিতে নারাজ। এ নিয়ে আমরা সর্বদা বিব্রত।’

বিদায়ের আগে ইসির আইন সংস্কারের উদ্যোগকে কীভাবে দেখছেন-জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রকিবউদ্দীন কমিশন যেমন বিদায়ের আগে আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের হাসির পাত্রে পরিণত করেছিল; বর্তমান কমিশন সে পথেই হাঁটছে। আমার মতে, বর্তমান যারা কমিশনার হিসেবে দায়িত্বে আছেন, সবারই চরিত্র মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলা যায়। তাই সঠিক সময় নির্ণয়ে গলদ থাকায় নিজেরাই নিজেদের উপহাসের পাত্রে পরিণত করছেন।’

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবির কাওসার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দুই দলে নারী নেতৃত্ব পূরণে আমরা আন্তরিক। করোনার কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। এজন্য আমরা আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় চেয়েছি। এরমধ্যে সবস্তরে দলে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব দেবে বলে আমরা আশা করছি।’

আর বিএনপির গণমাধ্যম উইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান বলেন, ‘দলে নারী নেতৃত্ব পূরণের জন্য মাঠপর্যায়ে কাজ চলছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এটা পূরণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো গাফিলতি নেই।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close