বিবিসি

  ০৯ মার্চ, ২০২১

এত মধু প্রশাসনে!

চিকিৎসা ও প্রকৌশল বিষয়ে পড়েও প্রশাসনিক ক্যাডারে চাকরি নিচ্ছেন অনেকে

বাংলাদেশে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়াকে বেশ সম্মানজনক বলে ধরা হলেও এসব বিষয় থেকে পাস করা অনেক শিক্ষার্থী এখন পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রশাসনিক ক্যাডারের পদ। তাদের মধ্যে অনেকে আছেন পুলিশ, প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও কর ক্যাডারে। পেশা হিসেবে প্রশাসনিক ক্যাডার বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে তারা মূলত ভালো বেতন, ধারাবাহিক পদোন্নতি ও চাকরির নিশ্চয়তার কথা বলেছেন।

ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের এই পেশা পরিবর্তনের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়ে এখন বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। এবার সদ্য যোগ দেওয়া ২৩ জনের মধ্যে ১৪ জনই ইঞ্জিনিয়ার, পাঁচজন ডাক্তার।’ গত শনিবার বুয়েটের এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি একে রাষ্ট্রের ক্ষতি বলেও উল্লেখ করেন। ইদানীং চিকিৎসা বা প্রকৌশলবিদ্যার ডিগ্রি নিয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিসিএস ক্যাডার হচ্ছে বলেও এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

মূলত প্রশাসনিক ক্যাডারে চাকরি হলে ধারাবাহিক পদোন্নতি, ড্রাইভারসহ গাড়ি সুবিধা, বাংলো বা সরকারি কোয়ার্টারে থাকা, বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা, অবসরের পর পেনশন, ভাতাসহ আরো নানা সুবিধা পাওয়ার সুযোগ থাকে। এ ছাড়া আলাদা অফিস কক্ষ, ব্যক্তিগত সহকারী এবং সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে সম্মান তো আছেই। এসব কিছু বিবেচনা করেই চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার চেয়ে প্রশাসনিক ক্যাডার হওয়াকেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।

চাকরির নিশ্চয়তা : ৩৮তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার হিসেবে যোগ দিয়েছেন তারেক লতিফ সামি। অথচ তিনি ছিলেন কুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকে তিনি প্রকৌশলী হতে চেয়েছেন। তার একবারও বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়টি মাথায় আসেনি। সামি বলেন, ‘কম্পিউটার সায়েন্সে পড়া শিক্ষার্থীদের সামনে দুটো পথ থাকে। এক, তারা দেশের প্রাইভেট ফার্মগুলোতে কাজ করতে পারে। না হলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে সেখানে সেটেল হতে পারে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশেই থাকব।’

কুয়েট থেকে পাস করার পর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন তারেক লতিফ সামি। সেখানে কাজ করে তার উপলব্ধি হয় যে, এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রতিষ্ঠান কখনো লোকসানের মুখে পড়লে ঢালাওভাবে সবার চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, ছাঁটাই হয়। তা আপনি যত ভালো কাজ করুন না কেন।

বেতন, সম্মান ও কাজের পরিবেশ : এত ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাজ করা সত্ত্বেও সামি মাস শেষে যে বেতন পেতেন, সেটাও যথেষ্ট ছিল না। তার সঙ্গে পড়া অন্য প্রকৌশলীদের অবস্থা ছিল আরো শোচনীয়। তিনি বলেন, ‘আইটিতে আগের চাইতে বেতন কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু সেটাও সরকারি চাকরির তুলনায় অনেক কম। তবে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়া অনেকেই দেখেছি মাত্র ১৫ হাজার টাকার বেতনে যোগ দিতেন। কারণ কোনো চাকরি নেই।’

এমন বাস্তবতার মুখেই সামি পুলিশ ক্যাডারকে ফার্স্ট চয়েস দিয়ে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। তার মতো সব শিক্ষার্থীর আস্থা যে, বিসিএসে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো দুর্নীতি হয় না। সামি এখন একজন পুলিশ ক্যাডার।

বাংলাদেশে আইসিটি ক্যাডার পদে সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হলেও সেটা আজ পর্যন্ত চালু হয়নি। বরং টেলিকমিউনিকেশন ক্যাডার পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া ২০০৭ সালেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমন অবস্থায় সামি জেনারেল ক্যাডার বেছে নেন, যেখানে কম্পিউটার প্রকৌশলীর প্রয়োজন আছে।

সামি বলেন, ‘পুলিশের আইটি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এখন কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। বিশেষ করে সাইবার ক্রাইমে এই বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন হয়। আমি সেটাই করছি।’

মূলত ২০১৫ সালে সরকারি চাকরির বেতন স্কেল বাড়ানোর পর সরকারি চাকরির প্রতি সবার আগ্রহ বাড়তে থাকে। ৯ম গ্রেডে চাকরির শুরুতেই একজনের বেসিক বেতন থাকে ২৩ হাজার ১০০ টাকা। অর্থাৎ মোট বেতন শুরুতেই ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার মতো হয়।

সামি বলেন, ‘এখানে বেতন ভালো, কাজের পরিবেশ অনেক ভালো। প্রাইভেটে কাজ করার সময় একটা ডেস্কে আমরা কয়েকজন বসতাম। এখানে আমার নিজস্ব কক্ষ আছে। অফিস সহকারী আছে।’ এ ছাড়া বাংলাদেশের একজন সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে তিনি যে সম্মান পেয়ে থাকেন, সেটা প্রকৌশলী থাকাকালীন ছিল না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

স্বাস্থ্য ক্যাডার না হয়ে জেনারেল ক্যাডার : চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু ভিন্ন। এখানে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে কেউ স্বাস্থ্য ক্যাডার হলেও তারা প্রশাসনিক ক্যাডারের অনেক সুবিধাই পান না বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক। তিনি জানান, বাংলাদেশে যেসব মেডিকেল শিক্ষার্থী এমবিবিএস ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর বিসিএস পরীক্ষা দেন ও সুযোগ পান তাদের নিয়োগ পেতে আরো দুই থেকে তিন বছর চলে যায়। চাকরির শুরুতে তাদের অন্তত দুই বছর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করতে হয়। সেখানে সরকারি কোয়ার্টারে ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়, গাড়ির কোনো সুব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও চলার মতো যথেষ্ট নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। উপজেলায় চিকিৎসকরা নানা ধরনের অপ্রত্যাশিত আচরণের শিকার হয়ে থাকেন বলে তিনি জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তাও একজন পুলিশ ক্যাডার। তার মতে, চিকিৎসকরা পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন অর্থাৎ এমডি, এমএস, এফসিপিএস ইত্যাদি ডিগ্রি সম্পন্ন না করলে পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই। এই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রির জন্য একজন চিকিৎসককে কয়েক বছর একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকের অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সেটার পর তিনি ফাইনাল পরীক্ষা দেন। যা শেষ করতে ৭ থেকে ১০ বছর সময় লাগে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। এর আগে ওই চিকিৎসক পদোন্নতির আবেদন করতে পারেন না।

এই পুরো সময় একজন চিকিৎসকের মাসিক ভাতা থাকে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মতো। যেখানে প্রশাসনিক ক্যাডারে বেতনও ভালো, পদোন্নতির সুযোগও পাওয়া যায় অনেক আগে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন পদ্ধতি অনেক দীর্ঘমেয়াদি এবং ইনস্টিটিউটগুলোতে আসনসংখ্যা খুবই কম। একটি সিটের জন্য অনেক সময় ৫০ জন ডাক্তারকে লড়াই করতে হয়। সেই একই চেষ্টা সে যদি বিসিএস পরীক্ষায় দেয়, তাহলে তাকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের চিন্তাটা করতে হয় না। তার ক্যারিয়ার গড়ে ওঠে। এটাকেই সবচেয়ে বড় মোটিভেশন বলে তিনি মনে করেন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘১০-১৫ বছর আগে বাংলাদেশে ডাক্তারের সংখ্যা অনেক কম ছিল। এখন প্রাইভেট মেডিকেল হয়েছে অনেক। সরকারের নিয়োগ দেওয়ার সক্ষমতার চাইতে এখন ডাক্তারের সংখ্যা বেশি। এতে চাকরি পাওয়ার সুযোগ কমে গেছে।’

যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৯ সালের হিসাবমতে, দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ২০ শতাংশের বেশি চিকিৎসক পদ খালি রয়েছে। বেসরকারি হিসাবে দেশের জেলা ও উপজেলায় ৬০ শতাংশের বেশি চিকিৎসক পদ খালি। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা ও রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় কমপক্ষে দুই লাখ চিকিৎসক প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

তবে চিকিৎসকদের জন্য পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষাকে সবচেয়ে বড় চাপ বলে মনে করেন ওই সরকারি কর্মকর্তা। তার মতে, বাংলাদেশে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি ছাড়া একজন ডাক্তারের কোনো মূল্য নেই। কারণ সবাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই খোঁজেন। কিন্তু এর পেছনে যে সময় লাগে, সেসময়ে অন্য ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ বেশি।

তাই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া এড়িয়ে যেতে এবং তার পাশাপাশি পদোন্নতি, গাড়ি-বাড়িসহ অন্যান্য সুবিধা পেতে চিকিৎসকরা আজকাল স্বাস্থ্য ক্যাডারের পরিবর্তে জেনারেল ক্যাডারে পরীক্ষা দিতেই বেশি আগ্রহী।

রাষ্ট্রের ক্ষতি : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্রমতে, এক প্রকৌশলীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে খরচ হয় তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা। অনেক সময় তার চেয়েও বেশি। এ ছাড়া সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয় বলে জানা গেছে।

এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, একজন শিক্ষার্থীকে চিকিৎসক হিসেবে তৈরি করতে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, সেই চিকিৎসক যখন অন্য পেশায় চলে যান, তখন তা রাষ্ট্রের জন্য বিশাল ক্ষতি।

মন্ত্রী জানান, যে বাংলাদেশে এক প্রকৌশল ও মেডিকেল শিক্ষার্থীর পড়াশোনার জন্য সরকারিভাবে যথেষ্ট অনুদান, ভর্তুকি দেওয়া হয়। এ কারণে ওই শিক্ষার্থীদের এই ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষা নিতে নিজের পকেট থেকে খুব একটা পয়সা খরচ করতে হয় না। তিনি বলেন, ‘ডাক্তাররা পেশা পরিবর্তন করলে আমার দুঃখ লাগে। এত কষ্ট করে ডাক্তারি পাস হয়, যারা মানুষের সেবার জন্য, একেবারে সরাসরি হেল্প করে। তারা পরে অন্য জায়গায় গেলে এটি রাষ্ট্রের ক্ষতি।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close