নিজস্ব প্রতিবেদক ও সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
বাঁচানো গেল না মুক্তামনিকে
রক্তনালিতে টিউমারে আক্রান্ত মুক্তামণি মারা গেছে। সাতক্ষীরা সদরের কামারবাইশা গ্রামে মুক্তামনির মরদেহ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। জানাজায় অংশ নেয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শত শত মানুষ। মুক্তামনির বাবা ইব্রাহিম গাজী বলেন, ‘মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে জ্বর এসেছিল মুক্তামনির। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক ডাক্তার সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে কথা বলি। তখন তিনি সাতক্ষীরা সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলে ডাক্তার পাঠিয়ে দেন বাড়িতে। সদর হাসপাতালের ডাক্তার হাফিজুল্লাহ ও ফরহাদ আলম এসে জ্বরের চিকিৎসা দেন। তাৎক্ষণিক আমি ওষুধপত্র নিয়ে আসি। দুপুরে ও রাতে সেই ওষুধ খাওয়াই। রাতে একটা ছফেদা খেয়েছিল। গতকাল বুধবার সকালে কিছু খায়নি। আমার হাতের ওপর মারা যায় মেয়েটি।’ এসব বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুক্তামনির বাবা।
জানাজায় অংশ নিয়ে সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ আসাদুজ্জামান বাবু বলেন, মুক্তামনিকে সুস্থ করতে কোনো গাফিলতি ছিল না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়ারও প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেখানকার ডাক্তাররা অপারেশনের জন্য অপারগতা প্রকাশ করেন।
এদিকে, মুক্তামনির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শত শত মানুষ এক নজর দেখার জন্য ভিড় করতে থাকে। তার বাড়িতে ছুটে এসেছিলেন সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান, সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মেরিনা আক্তার, জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি, সিভিল সার্জন সাতক্ষীরার প্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ। মুক্তামনির বাবা ইব্রাহিম গাজী, মা আসমা বেগম, বোন হীরামনি, দাদি সালেহা বেগমসহ গোটা পরিবার কান্নায় ভেঙে পড়ে।
মুক্তামনির দাদি সালেহা বলেন, ‘সকালে মুক্তামনি আমার কাছে পানি খেতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পানি খেতে পারেনি।’ এদিকে, শোকে স্তব্ধ মুক্তামনির মা আসমা বেগম কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। তার চোখে শুধুই অশ্রু। শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে মুক্তামনির সুস্থতা কামনাকারী কোটি মানুষ।
গত ১৯ মে মুক্তামনির সঙ্গে শেষ কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তখন মুক্তামনি বলে, ‘আমি আর সুস্থ হব না। জানি না এভাবে আর কত দিন বেঁচে থাকব। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার স্যাররা আমার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সুস্থ করতে পারেননি। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।’
এদিকে, মুক্তামনির মৃত্যু খুবই হৃদয়বিদারক বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক জীবনে আমার এমন সংবাদ খুব কমই শুনতে হয়েছে। মুক্তামনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ছয় মাস চিকিৎসা নিয়েছে। তার চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি ছিল না। হাসপাতালের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার জন্য সব চেষ্টা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ও যে রোগে ভুগছিল তা নিয়ে এমন পর্যায়ে আমাদের কাছে এসেছে, যখন আর কোনো উপায় ছিল না। আরো আগে যদি আসত তাহলে ডেফিনেটলি সেটা সারিয়ে তোলা যেত।’
ডা. সামন্ত বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) আমি তার বাসায় সিভিল সার্জনকে দিয়ে চিকিৎসকও পাঠিয়েছিলাম। আমার চিকিৎসকরা গিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ ধরে ওর বাবার সঙ্গে কথা বলেছি। আসতে বলছিলাম। ওরা কিছুতেই আসতে চায় না। কালকে চিকিৎসকরা তাকে দেখার পর আমাকে বলল, স্যার অত্যন্ত রক্তশূন্যতায় ভুগছে মুক্তামনি। তাকে ব্লাড দিতে হবে। আজকে (বুধবার) সকালেও অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গেছিল, কিন্তু কিছু করার নেই। ওরা এলো না। খুবই দুঃখজনক।’
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন তওহীদুর রহমান বলেন, অবস্থার অবনতি হয়েছে শুনে গত মঙ্গলবার দুপুরে তিনি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ফরহাদ জামিল ও অর্থোপেডিকস বিশেষজ্ঞ মো. হাফিজুল্লাহকে মুক্তামনির বাড়িতে পাঠান। ফরহাদ জামিল বলেন, তিনি ও হাফিজুল্লাহ মঙ্গলবার দুপুরে মুক্তামনির বাড়িতে গিয়েছিলেন। মুক্তামনির শরীরে তখন জ্বর ছিল। রক্তশূন্যতায় ভুগছিল সে। হাতের ক্ষত আরো বেড়ে গিয়েছিল। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। তার রোগ শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভালো করে সে কথা বলতে পারছিল না। বিষয়টি তারা ডা. সামন্ত লাল সেনকে বিস্তারিত জানান। তবে মুক্তামনি ও তার বাবা ইব্রাহিম হোসেন আর ঢাকায় যেতে চাচ্ছিলেন না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মুক্তামনিকে ভর্তি করা হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে বার্ন ইউনিটের কেবিনে ছিল ছয় মাস। গত বছরের ১২ আগস্ট তার হাতে অস্ত্রোপচার হয়। তার ডান হাত থেকে প্রায় তিন কেজি ওজনের টিউমার অপসারণ করেন চিকিৎসকরা। পরে দুই পায়ের চামড়া নিয়ে দুই দফায় তার হাতে লাগানো হয়। তবে সাময়িকভাবে হাতের ফোলা কমলেও তা সম্প্রতি আগের চেয়েও বেশি ফুলে গিয়েছিল। রক্ত জমতে থাকে ফোলা জায়গায়। আর ড্রেসিং করতে কয়েক দিন দেরি হলেই হাত থেকে দুর্গন্ধ বের হতো। আগের মতো হাতটিতে পোকাও দেখা যায়। মুক্তামনির বয়স হয়েছিল ১১ বছর। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর এক মাসের ছুটিতে বার্ন ইউনিট থেকে মুক্তামনি বাড়ি ফেরে। তবে ওর আর ঢাকায় ফেরা হয়নি।
"