আরিফুল কাদের

  ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

বার্ধক্যে বাবা-মা : কিছু করণীয়-বর্জনীয়

বার্ধক্য মানবজীবনে অবশ্যই আসবে। আমরা শত চেষ্টা করেও তা রুখতে পারব না। সেই সক্ষমতা আমাদের নেই। প্রত্যেক মানুষকেই বার্ধক্যে উপনীত হতে হবে। সন্তানের যেমন বাবা-মায়ের প্রতি হক ও অধিকার রয়েছে, তেমনি বাবা-মায়েরও সন্তানের প্রতি কিছু হক ও অধিকার রয়েছে। উভয়ের জন্য এই হক ও অধিকার আদায় করা বাধ্যতামূলক। সন্তান যখন ভূমিষ্ঠ হয় তারপর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সন্তানের দায়ভার সম্পূর্ণ বাবা-মায়ের ওপর। তাকে আদর-যত্ন করা, ভালোবাসা দেওয়া, সর্বোপরি তাকে সুশিক্ষা দিয়ে বড় করে গড়ে তোলা বাবা-মায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আবার একই বাবা-মা যখন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থেকে শুরু করে, তখন তাদের দায়িত্ব নেওয়া সন্তানের কর্তব্য। প্রত্যেককে আলাদাভাবে তাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। ছোটবেলায় আমরা নিজের অবুঝ মনে অনেক ভুলভ্রান্তি, অন্যায়ও করে থাকি। মা-বাবা হাসিমুখে তা মেনে নেন। সন্তানের ভুলের জন্য মা-বাবা তাকে কখনো ত্যাগ করেন না। অনেক সময় দেখা যায়, সন্তানের কোনো ভুল বা অন্যায়ের জন্য বাবা-মা নারাজ হন। সন্তানের প্রতি তারা রাগান্বিত হন। আসলে সত্যিকার অর্থে এটি রাগ নয়, বরং অভিমান। মানুষ চাইলে যে কারো প্রতি রাগ করতে পারে। কিন্তু যে কারো প্রতি অভিমান করতে পারে না। অভিমান সবার প্রতি হয় না। অভিমান শুধু তাদের প্রতি হয় যাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি থাকে। আর সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসা পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ রাখে না। কিন্তু সন্তান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কেন যেন মনে হয় এই ভালোবাসা কমতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন পরিবর্তন হতে শুরু করে। যার কারণে বয়সের সঙ্গে মানুষের আচার-ব্যবহারেও পরিবর্তন ঘটে। বিশেষ করে ৪০ বছর বয়সের পর থেকে এই আচার-ব্যবহারে পরিবর্তন বাড়তে শুরু করে। জীবনের একপর্যায়ে গিয়ে তাদের আচার-ব্যবহার পুরোপুরি পাল্টেও যেতে পারে। এমতাবস্থায় তাদের প্রতি আমাদের আচরণ ও কর্তব্য কেমন হওয়া উচিত?

ছোটবেলায় বা কৈশোরে আমরা মা-বাবার সঙ্গে যে আচরণ করি একই আচরণ বার্ধক্যে করা যায় না। সন্তান যখন ছোট থাকে কিংবা কৈশোরে পদার্পণ করে, তখনো বাবা-মায়ের আচরণ ও কর্তব্য বেশ প্রফুল্ল থাকে। তখন আমাদের ছোট-বড় ভুলগুলো নিয়ে তারা ভাবতে পারে। তাই তারা এখানে ভালোমন্দ বিচার করতে পারে। কিন্তু যখন তারা বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তাদের আর এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে খুব একটা ভালো লাগে না। তখন ভাবনার বিষয়গুলো তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রভাব ফেলে। তাই এ সময় তাদের প্রতি আমাদের আচার-ব্যবহারেও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।

এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় ও বর্জনীয় : আজকের বিজ্ঞান বলে মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। যে বিষয়গুলো তারা একসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ-আলোচনা করতেন, সেই বিষয়গুলো বার্ধক্যে শুনতেই বিরক্ত লাগে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান কমতে শুরু করে। স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে শুরু করে। ফলে অনেক সময় অনেক কথাও তারা ভুলে যায়। এমতাবস্থায় কোনোভাবে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। ধীরে ধীরে খুব স্বাভাবিকভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

তাদের কোনো কাজ করতে বলেছেন আর তারা তা ভুলে গেছে, সে ক্ষেত্রে আমাদের স্বাভাবিক থাকতে হবে। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ স্বাভাবিকভাবে কিছুটা ভীত থাকে। তাই প্রয়োজনে মুচকি হাসি দিয়ে এমন ভাব দেখাতে হবে যেন কিছুই হয়নি।

তাদের পক্ষাবলম্বন করতে হবে : তাদের ভুলভ্রান্তিতে পক্ষাবলম্বন করতে হবে। তারা যত বড় ভুল বা অন্যায় করুক না কেন, অন্তত তাদের সামনে আপনাকে এমন ভান করতে হবে যেন কিছুই হয়নি। এমন আচরণ করতে হবে, যেন তারা নিজেরাই আত্মতৃপ্তি পায়। কখনো বাবা-মাকে আদেশ করা যাবে না। তাদের অনুরোধ করতে হবে। যেকোনো কাজ তাদের মাধ্যমে সম্পাদন করার জন্য তাদের সঙ্গে এমনভাবে আচরণ করতে হবে, যেন আপনি তাদের সামনে কিছুই না। অনেকাংশে আপনি তাদের দয়ায় বেঁচে আছেন, সেই অনুভূতি যেন তাদের মনে জাগে।

তাদের রাগে রাগান্বিত হওয়া যাবে না : বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। কথায় কথায় রাগান্বিত হতে দেখা যায়, কিংবা সামান্য আওয়াজেই তারা বিরক্তির সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের নিজেকে সামলাতে হবে। মনে রাখতে হবে বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার মধ্যে এ বিষয়টি চলে আসে। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার জন্য অকপটে নিজেকে অপরাধী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। নিজের ভুল বা নিজেকে দোষী মনে করে নিরহংকারের সঙ্গে নিজের দোষের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে।

তাদের কখনো একাকিত্ব বোধ করতে দেওয়া যাবে না : বার্ধক্যে মানুষ বেশির ভাগ সময় একাকিত্বে ভুগতে থাকে। এমতাবস্থায় বাবা-মা যেন একাকিত্ব অনুভব না করে সেদিকে নজর রাখতে হবে। একাকিত্ব দূর করার জন্য তাদের এমন পরিবেশে রাখতে হবে, যেখানে মানুষের ঘনিষ্ঠতা পাওয়া যায়। এমন মানুষ যারা সব সময় তাদের প্রতি সদয় ও আন্তরিক। যেই মানুষগুলো তাদের ও তাদের ইচ্ছাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে। ফলে তারা মানসিকভাবে বেশ প্রফুল্ল থাকবে।

তাদের ছোট ভুলগুলো ক্ষমা করতে হবে : বয়স বাড়ার সঙ্গে মানুষের মধ্যে ভুলের প্রবণতা বাড়তে শুরু করে। এমতাবস্থায় তাদের সঙ্গে উচ্চবাক্যে কথা বলা তো দূরের কথা, তাদের প্রতি রাগান্বিত স্বরে তাকানোও যাবে না। বলা হয়ে থাকে, মানুষের অন্তরের ভাব নাকি মুখের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। তাই কখনো রাগান্বিত বা অসন্তুষ্ট চেহারা নিয়ে তাদের সামনে হাজির হওয়া যাবে না।

তাদের উপহার দেওয়া যেতে পারে : মানুষ উপহার পেতে ভালোবাসে। মাঝেমধ্যে তাদের না জানিয়ে হুট করে কিছু উপহার দেওয়া যেতে পারে। এতে তারা বেশ সন্তুষ্ট হবে। সন্তান হিসেবে বাবা-মায়ের জন্য অবশ্যই সময় নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দিনের যেকোনো সময় তাদের জন্য বরাদ্দ করে রাখা যেতে পারে। ওই সময় আমাদের অবশ্যই তাদের সঙ্গে থাকতে হবে। কখনো কখনো তাদের সঙ্গী করে আমরা ঘুরতে যেতে পারি, কখনোবা ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে একসঙ্গে ডিনার বা লাঞ্চ করা যেতে পারে।

তাদের ইচ্ছা ও চাওয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে : অভিভাবক হিসেবে বাবা-মা সব সময় সন্তানের প্রতি অধিকার ফলানোর চেষ্টা করেন। এই অধিকার তারা অবশ্যই রাখেন। এই অধিকারের প্রতি আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। বাবা-মা অনেক সময় চান আমরা তাদের ইচ্ছানুযায়ী চলি। অথবা তাদের দেখানো পথেই যেন আমরা চলি। বাবা-মা সন্তানের কাছ থেকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি চান তা হলো সৎ ব্যবহার। বলা হয় আল্লাহ্ ও তার রাসুল (সা.)-এর পর কেউ যদি সবচেয়ে বেশি সম্মান ও উত্তম আচরণের দাবিদার হয়ে থাকেন, তবে তারা হলেন বাবা-মা। তাই তাদের সঙ্গে সর্বদা উত্তম আচরণ করতে হবে। এমন কথাও বলা যাবে না যা দ্বারা তাদের অন্তরে বিন্দু পরিমাণ আঘাত আসে। অনেক সময় তাদের বেশ কিছু আচার-আচরণ আমাদের পছন্দ হয় না। আমাদের অনেকের ইচ্ছা ও চাহিদার বিরুদ্ধে যায়। সে ক্ষেত্রে আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বিষয়গুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। এমনভাবে আলাপ-আলোচনা করতে হবে যেন তারা কোনো কষ্ট না পান। এই পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যক্তিত্ব তাদের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যেন তাদের কাছে আমরা কিছুই না। আমরা তাদের দয়ার ভিখারি।

তাদের স্বাস্থ্যের খবরাখবর রাখা : বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শরীরের রোগ-জীবাণুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে শুরু করে। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমতে শুরু করে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। শ্রবণশক্তি কমতে থাকে। আচার-আচরণে পরিবর্তন আসে। এ সময় উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস থেকে শুরু করে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে শুরু করে। এ জন্য জীবনের এই মুহূর্তগুলোতে তাদের শারীরিক খোঁজখবর রাখা খুবই জরুরি। প্রয়োজনে নিয়মিত ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close