আবদুল লতিফ মণ্ডল

  ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

স্বদেশ ভাবনা

পাটশিল্প পুনরুজ্জীবিত হোক

পাটকে কৃষিজাত পণ্যের স্বীকৃতি ও প্রণোদনা এবং পাটের তৈরি পণ্যকে রপ্তানি পণ্যের প্রণোদনা প্রদানের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৪ মার্চ রাজধানীতে জাতীয় পাট দিবসের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘অনেক বাজার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। পাটের বহুমুখী উৎপাদন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাট কৃষিজাত পণ্য। শিল্পের কাঁচামালও। রপ্তানিও হয়। এটি কৃষির প্রণোদনা পায় না, রপ্তানি পণ্যের প্রণোদনাও পায় না। আমি পরিবেশবান্ধব এ পণ্যকে কৃষিজাত ও রপ্তানিমুখী পণ্যের স্বীকৃতি দেব এবং প্রণোদনা দেব।’ পাটসংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘পরিবেশবান্ধব পণ্যের বিশাল বাজার থাকায় রপ্তানি বাড়াতে নতুন পাটজাত পণ্য উদ্ভাবন এবং বিদেশে নতুন বাজার খুঁজে বের করুন।’ প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা ও নির্দেশ বাস্তবায়িত হলে পাটচাষ সম্প্রসারণে পাটচাষিরা উৎসাহিত হবেন, যা পাটের উৎপাদন বাড়াবে, ঘটবে পাটশিল্পের উন্নয়ন এবং পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে সমৃদ্ধ হবে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার। তাই সরকারপ্রধানের এই ঘোষণা প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে।

পাটচাষ, পাটজাত সামগ্রী তৈরি, পাট ও পাটজাত পণ্যাদির ব্যবসা-বাণিজ্য বহুকাল ধরে এ দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমান বাংলাদেশ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকাকালে (১৯৪৭-৭০) কাঁচাপাট ও পাটজাত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস ছিল। স্বাধীনতার প্রাক্কালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ পাটকলের মালিক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি পাটকল মালিকরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় এসব পাটকল রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। বেসরকারি খাতে পাট ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অভ্যন্তরীণভাবে পাট কেনা ও পাটপণ্য উৎপাদনের একচেটিয়া দায়িত্ব বর্তায় ৮২টি পাটকল নিয়ে গঠিত সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) ওপর। পাট রপ্তানির একচেটিয়া দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ পাট রপ্তানি সংস্থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে অনভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের এসব পাটকলের ব্যবস্থাপনা, পাটজাত পণ্য উৎপাদন, পাট রপ্তানির দায়িত্ব প্রদান, দুর্নীতি, মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব, শ্রমিক অসন্তোষ, পলিপ্রোপাইলিন নামক কৃত্রিম তন্তুর আবির্ভাব, কয়েকটি দেশের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়া ইত্যাদি কারণে পাটশিল্পে বিপর্যয় দেখা দেয়। এসব কারণে ৭৫-পরবর্তী সরকার পাটকলগুলোর বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে, যা পরবর্তীকালে অব্যাহত থাকে। অনুমতি দেওয়া হয় বেসরকারি খাতে পাটকল স্থাপন, পাটপণ্য ও কাঁচা পাট রপ্তানির। ২০২০ সালের ১ জুলাই রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকল বন্ধ ঘোষণার আগ পর্যন্ত দেশে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাত পাটজাতসামগ্রী উৎপাদন ও রপ্তানিতে নিয়োজিত ছিল।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক. পাটকে কৃষিজাত পণ্যের স্বীকৃতি ও প্রণোদনা প্রদান, খ. পাটপণ্যকে রপ্তানিমুখী পণ্যের প্রণোদনা প্রদান, গ. বন্ধ পড়ে থাকা ২৬টি সরকারনিয়ন্ত্রিত পাটকলের মধ্যে ৬টি বেসরকারি খাতে হস্তান্তর ও চালু করার মাধ্যমে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করা।

প্রধানমন্ত্রী পাটকে কৃষিজাত পণ্যের স্বীকৃতি ও প্রণোদনা প্রদানের ঘোষণার মাধ্যমে পাটকে প্রণোদনা পাওয়া অন্যান্য কৃষিপণ্যের সারিতে নিয়ে এলেন। সরকার উচ্চফলনশীল আউশ ধান, পেঁয়াজ, সবজিসহ ফল-ফুল, মাছ ইত্যাদি উৎপাদনে প্রণোদনা দিয়ে আসছে। পার্বত্য জেলাগুলোতে জুমচাষিরাও এ প্রণোদনা পাচ্ছেন। পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে প্রণোদনা দেওয়া হলে পাটচাষিরা পাটচাষ সম্প্রসারণে আগ্রহী হবেন। এটা ঠিক, দেশে পাট উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৪.২ লাখ হেক্টর জমিতে পাটচাষ হয় এবং উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮.৩৮ লাখ টনে। ২০১০-১১ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যথাক্রমে ৭.০৮ ও ৭.২৫ লাখ হেক্টর জমিতে পাটচাষ হয় এবং উৎপাদিত পাটের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৫.২৬ ও ১৩.৭৪ লাখ টন। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭.৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে ১৫.০২ লাখ টন পাট উৎপাদন হয়। এর অর্থ হলো পাট উৎপাদনে ধারাবাহিকতার অভাব। বিজেআরআইয়ের তথ্য মোতাবেক ২০০৫-০৬, ২০১০-১১ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি পাট উৎপাদন দাঁড়ায় যথাক্রমে ২.০৮, ২.১৫ ও ১.৯০ টনে। আরেক সূত্রে জানা যায়, চীনে ১ একর জমিতে ১.১৫ টন পাটের ফলনের বিপরীতে বাংলাদেশে ১ একর জমিতে পাটের ফলন ০.৬৮ টন। ভারতেও একর বা হেক্টরপ্রতি পাট উৎপাদন বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭.৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে যখন ১৫.০২ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়, তখন ভারতে ৬.৪০ লাখ হেক্টর জমিতে ১৭.৩৫ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়। পাট উৎপাদনে ধারাবাহিকতার অভাব এবং উৎপাদনশীলতার কারণে কৃষকপর্যায়ে পাটচাষ লাভজনক হচ্ছে না।

রপ্তানি হওয়া যেসব কৃষিপণ্য সরকার থেকে প্রণোদনা পাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- সুগন্ধি চাল, শাকসবজি, ফল-মূল ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক পাট রপ্তানিমুখী পণ্যের স্বীকৃতি ও প্রণোদনা পেলে তা পাটজাতসামগ্রীর রপ্তানি বৃদ্ধিতে উৎসাহ জোগাবে। পাটজাতসামগ্রীর রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেলেও তাতে ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-এর তথ্যে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাটজাত পণ্যগুলো থেকে রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৮০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ১০২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বৃদ্ধি পায়, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে হ্রাস পেয়ে ৯১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। কাঁচা পাট রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। উপর্যুক্ত সূত্রে জানা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে কাঁচা পাট রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয় ২৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হ্রাস পেয়ে ১১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অর্জিত ১৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে আসে। ২০২১-২২ অর্থবছরে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে আয় দাঁড়ায় ২১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়িত হলে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ধারাবাহিকতা আসবে এবং বাড়বে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ। তবে এজন্য আমাদের পাটের বহুমুখী উৎপাদন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং বিদেশে পাটপণ্যের বাজার খুঁজে বের করতে হবে।

অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি বন্ধ পাটকল বেসরকারি খাতের ইজারাদারদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। যারা এসব পাটকলের ইজারা পেয়েছেন, তাদের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তারা এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আনবেন এবং মিলগুলো যৌথভাবে পরিচালনা করবেন।’ ভালো আশা করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে অন্য কথা। ১৯৭৭-৯৬ সময়কালে ৪৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর আরো কয়েকটি মিল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বিজেএমসির অধীনে থাকে, যার মধ্যে ২৫টি চালু অবস্থায়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে পাটকল ছেড়ে দেওয়ার ফলাফল মোটেই সুখকর হয়নি। বেসরকারি খাতে কম দামে ছেড়ে দেওয়া পাটকলগুলোর সম্পদ বিক্রি করে মালিকরা লাভবান হয়েছেন। তারা মিল বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, মিল যথাযথভাবে চালাননি, শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন। যেসব পাটকল বেসরকারি উদ্যোক্তারা লিজ নিয়েছিলেন, সেগুলোও চলেনি।

সদ্য ইজারা দেওয়া পাটকলগুলোর চুক্তিতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ কতটা রক্ষিত হয়েছে জানা নেই। তবে এসব পাটকল যেন চালু থেকে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। প্রায় চার বছর বন্ধ পড়ে থাকা বাকি ২০টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের ইজারা প্রদানের ব্যাপারেও সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বন্ধ ঘোষণার আগে এসব পাটকলে হেসিয়ান, স্যাকিং, কার্পেট ব্যাকিং, ক্লথ, উন্নতমানের রপ্তানিযোগ্য পাটের সুতা, জিওজুট, কটন ব্যাগ, নার্সারি পট, ফাইল কভার ইত্যাদি উৎপাদিত হতো। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০-এর তথ্য মোতাবেক, বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকলগুলোতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ছিল ৭২,০১০ টন। এসব পাটকল পাটজাত পণ্য উৎপাদনে না থাকায় এবং শুধু বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোয় কাঁচা পাটের চাহিদা থাকায় কাঁচা পাটের চাহিদা কমে গেছে, যা স্থানীয় বাজারে কাঁচা পাটের মূল্য হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে। এর ফলে পাটচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং তারা পাটচাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তাই পাটচাষিদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

সবশেষে বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সিদ্ধান্তগুলো ও নির্দেশের বাস্তবায়ন পাট ও পাটশিল্পের উন্নতিতে সহায়ক হবে। পাট দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠুক- এই লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।

লেখক : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close