ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম

  ১৭ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

বঙ্গবন্ধুর আদর্শই দেশকে এগিয়ে নেবে

তিনি ১৯৪০ সালের গোড়ায় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় ছাত্রনেতার খেতাব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর রাষ্ট্রভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে চাপিয়ে দিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই শেখ মুজিব ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু করেছিলেন।

শুরুতেই ওই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা থাকায়, শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত জেলখানায় ছিলেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, তিনি জেলখানা থেকেও ভাষার জন্য আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলেন। শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন, যা বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানের শোষণ ও নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। শেখ মুজিব মওলানা ভাসানী ও ইয়ার মোহাম্মদ খানের সঙ্গে মিলে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছিলেন। তিনি ওই সংগঠনের পূর্ব বাংলা ইউনিটের যুগ্ম সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সময় থেকেই শেখ মুজিব তৃণমূল পর্যায়ে রাজনীতির কার্যক্রম শুরু করেছিলেন।

বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে আইয়ুব খানকে সমর্থন দেননি। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এক বছর জেলে থাকতে হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা ছিল বাঙালি জাতির বেঁচে থাকার সনদ। ওই ৬ দফায় সংসদীয় পদ্ধতিতে জনগণের সরাসরি ভোটে ফেডারেল সরকার গঠনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। গঠিত ফেডারেল সরকার শুধু প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক দেখবে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি পৃথক মুদ্রা চালুরও ইঙ্গিত ছিল। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে সমগ্র পাকিস্তানে একটি মুদ্রাই থাকবে, যা সহজেই বিনিময়যোগ্য হবে। তিনি একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংকের কথাও উল্লেখ করেছিলেন।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছয় দফার জন্য আইয়ুব খান সরকার কর্তৃক নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়েছিল। আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি গণ-আন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্যও হয়েছিল।

১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত ১১ দফা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক লাহোরে ঘোষিত ছয় দফারই প্রতিফলন ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সাতটি মহিলা আসনসহ ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি আরো বলেন, প্রত্যেক পাড়া ও মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।

পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্তানে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ চালায়। ওই অপারেশনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী, কৃষক ও শ্রমিকসহ বহু সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, যাকে ইতিহাসের বর্বর হত্যাকাণ্ড নামে আখ্যায়িত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে গ্রেপ্তারের আগেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গেই বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার মুখ দেখে।

ইতিহাস পর্যালোচনায় আরো দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়েছিলেন। তারপরও বাঙালি জাতি কতটা অকৃতজ্ঞ, ইতিহাসই তার কালের সাক্ষী হয়ে আছে। সেই ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। যদিও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। সেদিন ছোট্ট শেখ রাসেলও ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পাননি। ঘাতকরা তারপরও ক্ষান্ত হয়নি; পরবর্তী সময়ে ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও বিশ্বাসী ছিলেন।

আজ ক্ষমতায় আছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। যদি এ নেতৃত্বের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিচ্যুতি ঘটে, তাহলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংগঠনটি ভবিষ্যতে দুর্বল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের মাঝে বাঙালি জাতির নীতি, আদর্শ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা লুকিয়ে রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি আস্থাশীল সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী ব্যক্তিদের মূল্যায়নের মাধ্যমেই বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close