তানজিব রহমান

  ১৬ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

ড. ইউনূস সম্পর্কে কতটা জেনে মায়াকান্না করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে

বিশ্ব কূটনীতিকদের আচার-আচরণ কেমন হবে, রাষ্ট্রীয় কী কী সুযোগ-সুবিধা পাবেন, নিরাপত্তা ও আইনি সুবিধাসহ অন্যান্য যেসব সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন তা নির্ধারিত হয় ভিয়েনা কনভেশন অনুযায়ী। জাতিসংঘের সহায়তায় ১৯৬১ সালে তৈরি করা হয়েছিল ভিয়েনা কনভেনশন। যেখানে একজন কূটনীতিক গ্রহীতা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেই পারেন না এবং আইনের বাইরে গিয়ে কথা বলা তো এক ধরনের ধৃষ্টতার শামিল। যা ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ ধারার স্পষ্ট লঙ্ঘন, এই ধারার ১ নং উপধারায় বলা হয়েছে, যেসব ব্যক্তি অন্য কোনো দেশে কূটনীতিকের মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করেন তারা ওই দেশের আইন ও নীতি মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। এ ছাড়া তারা ওই দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। কিন্তু আমরা দেখছি মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ভিয়েনা কনভেনশনকে একের পর এক লঙ্ঘন করেই চলেছেন। সম্প্রতি এ রাষ্ট্রদূত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ড. ইউনূস ইস্যুতে বলেন, ‘এই মামলাগুলো বাংলাদেশের শ্রম আইনের অপব্যবহার হিসেবে উদাহরণ হতে পারে।’

অধ্যাপক ড. ইউনূস শ্রম আইন লঙ্ঘন করে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকদের পাওনা আর্থিক সুবিধা (অনিয়মের মাধ্যমে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের ৫ শতাংশ না দেওয়া এবং ১০১ জন শ্রমিকের চাকরি স্থায়ী না করা। এ ছাড়া গণছুটি না দেওয়া, শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল এবং অংশগ্রহণ তহবিল গঠন না করা) হতে বঞ্চিত করেন, যা কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা মামলার রায়ে প্রমাণিত হয়। কিন্তু এ নিয়ে ড. ইউনূস তার দেশি-বিদেশি শক্তির মহড়া প্রদর্শন করে চলেছেন। কখনো বিদেশি বন্ধুরা বিবৃতি দেয় তো কখনো নোবেল বিজয়ীরা বিবৃতি দেয়, যেন ড. ইউনূসকে হয়রানি করা না হয়। আবার এও সত্য যে তারা প্রকৃত ঘটনার বৃত্তান্ত না জেনেই মন্তব্য বিবৃতি দেন, যা তাদের লেখাতেও ওঠে এসেছে। এর চেয়েও আরো কদর্য বিষয় হচ্ছে গত ৫ মার্চ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাস ভবনে এক নৈশভোজে দাওয়াতে অংশগ্রহণ করেন ড. ইউনূস যেখানে পিটার হাস ঢাকা মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেন, ‘এই মামলাগুলো বাংলাদেশের শ্রম আইনের অপব্যবহার হিসেবে উদাহরণ হতে পারে।’ একজন রাষ্ট্রদূত কি কোনো দেশের আইনি বিষয়ে এমন মন্তব্য করতে পারেন? ভিয়েনা কনভেনশন অন্তত তা বলে না। তিনি ওই পোস্টে আরো লিখেন, ড. ইউনূস ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলোর অগ্রগতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি মার্কিন রাষ্ট্রদূত উদ্বেগ প্রকাশ করেন, এই মামলাগুলো বাংলাদেশের শ্রম আইনের অপব্যবহার হিসেবে উদাহরণ হতে পারে। অন্যদিকে, লিংকডইন পোস্টে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হাস লিখেন, ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং নূরজাহান বেগমের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতির লক্ষ্যে তাদের অসাধারণ কাজ সম্পর্কে কথা বলা অবিশ্বাস্য সৌভাগ্যের বিষয় ছিল। তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে এবং আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। আপনারা যে কাজ করেন, তার জন্য ধন্যবাদ।’

ড. ইউনূস সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে মায়া কান্না পশ্চিমারা দেখাচ্ছে তার কারণ কী? প্রশ্ন করা যেতেই পারে। কদিন আগেও তো আমরা দেখলাম অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বিশ্বভারতির কাছে জমি সংক্রান্ত মামলায় কী পরিমাণ হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন, তখন পশ্চিমারা কোথায় ছিলেন তাদের বিবৃতির ঝাণ্ডা নিয়ে! কেউ তো এগিয়ে আসেননি। তাহলে কী ড. ইউনূস তাদের কোনো স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার? প্রশ্নের দাবি রাখে। সম্প্রতি ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মাল্টি বিলিয়নিয়ার স্যার রিচার্ড ব্র্যানসনও ড. ইউনূসের পাশে আছেন এমন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার) এ প্রকাশ করেছেন। অথচ তিনি নিজেও একজন কর ফাঁকির দায়ে অভিযুক্ত। কর ফাঁকির দায়ে রয়টার্স ও বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ফোর্বস যাকে ‘রেপুটেশন কিলার’ হিসেবে অভিহিত করেছে। অথচ তাদের মায়াকান্নাকে পুঁজি করতে চাইছে বাংলাদেশের একটি শ্রেণি।

এবার আসা যাক আইনি বিষয়ে কেন বিদেশিরা না জেনে হস্তক্ষেপ করবেন? আর ড. ইউনূস এর জন্যই কেন পশ্চিমাদের এত মায়া কান্না এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমাদের যেতে হবে আশির দশকে যখন বাংলাদেশে জেনারেলতন্ত্র বহমান। জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল এরশাদ। তখন পশ্চিমারা বাংলাদেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে ছক আঁকতে থাকে। এমন রাজনৈতিক ছককেই ৭৫-এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার-পরিজনদের জীবন দিতে হয়েছে বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মত। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশি সাংবাদিক ও মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্ট আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ফারুখ ফয়সল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে যান। সেখানে তিনি স্টেটডিপার্টমেন্টের এক মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং দক্ষিণ এশিয়ার মার্কিন আঞ্চলিক কর্মকর্তা তার কাছে জানতে চান বাংলাদেশে যে সামরিক শাসকরা একের পর এক ক্ষমতা দখল করছে সেখানে ড. ইউনূসের মতো কাউকে ক্ষমতায় বসালে কেমন হয়? অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৮৭ সাল থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ড. ইউনূসের জন্য আসন তৈরি করে রেখেছেন। যা এখন পর্যন্ত কোনোভাবেই পশ্চিমাদের আশা পূরণ করতে পারছে না। যার সর্বোচ্চ চেষ্টা হয়েছিল ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। তখন ড. ইউনূস রাজনৈতিক দল হিসেবে নাগরিক শক্তির নামও ঘোষণা করেছিলেন। বিধি বাম বাংলাদেশের জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।

পিটার হাস কোনো যুক্তিতেই বলতে পারেন না ‘এই মামলাগুলো বাংলাদেশের শ্রম আইনের অপব্যবহার হিসেবে উদাহরণ হতে পারে।’ যা স্পষ্ট আইনের লঙ্ঘন বাংলাদেশের শ্রম আইন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর নীতিমালা ও মান বজায় রেখে করা হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রম আইন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও কর্তৃক স্বীকৃত। শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। যারা ড. ইউনূসের জন্য মায়াকান্না করছেন তারা কি শ্রম আইনের এ ধারাগুলোর সুস্পষ্ট খবর রাখেন? রাষ্ট্রদূতের এমন বক্তব্য কেবল বাংলাদেশের আইন অবমাননা নয় এটা আইএলওকে অবমাননার শামিল। সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত তার এ বক্তব্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কেন না তিনি আইনি বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখেন না।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close