মো. সাখাওয়াত হোসেন
দৃষ্টিপাত
স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ
নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই রাজনৈতিক দলগুলো নড়েচড়ে বসে এবং নির্বাচন ঘিরে জমজমাট আয়োজন ও তুমুল প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। দলের মধ্যে প্রার্থী সিলেকশনের ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ, বিরোধ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সর্বোপরী দল সমর্থিত প্রার্থীকে জিতাতে নেতাকর্মীরা মরিয়া হয়ে কাজ করে, উঠেপড়ে লেগে যায়। দল থেকে মনোনীত প্রার্থীকে জেতাতে ইশতেহার প্রদানসহ নানা রকমের কার্যক্রম হাতে গ্রহণ করে দলীয় কর্তৃপক্ষ। আবার অনেক সময় নির্বাচনের কৌশল হিসেবে দলীয়ভাবে প্রার্থী সমর্থন থেকে বিরত থেকে দলীয় মানুষদের উন্মুক্ত ভোটদানের সুযোগ করে দেওয়া হয়ে থাকে। যাই কিছু গ্রহণ করা হোক না কেন নির্বাচনের পদ্ধতি ও কৌশলকে অবলম্বন করেই নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি পরিচালিত হয়ে থাকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে আলোচনা, সমালোচনা ও জয়পরাজয়ের হিসাবনিকাশ শুরু হয়েছে।
ইত্যবসরে দেশের কয়েকটি জায়গায় ৯ মার্চ বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন কেন্দ্র করে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু প্রতীকবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেহেতু উন্মুক্ত ভোট বলা যায় এসব নির্বাচন ঘিরে। আবার দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের দলীয় পদে থেকে যারা নির্বাচন করছেন, সেসব জায়গায় নেতাকর্মীরা প্রার্থীর পেছনে অবস্থান গ্রহণ করে বিভক্ত হয়ে নির্বাচন পরিচালনা করছে। এ জায়গায় আমার মনে হয় দলীয় প্রতীক না থাকলেও দলীয়ভাবে প্রার্থীদের সমর্থন প্রদান করে যেতে পারে। তবে সমর্থনের আগে প্রকৃত হিসাবনিকাশ করেই প্রার্থীদের সমর্থন দেওয়া উচিত। দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে, অনেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে এবং তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হওয়ার উদাহরণও রয়েছে। পরে পত্রিকার সংবাদে জানা গেছে, এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা একটা সময় অন্য আদর্শের অনুসারী ছিলেন, সুবিধা পেয়ে কিংবা আগের পরিচয় লুকিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছে। এ শ্রেণিটিই আবার বিভিন্ন সমীকরণকে অনুসরণ করে কিংবা লবিং করে; লবিষ্ট নিয়োগ করে দল থেকে মনোনয়ন পেয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।
এখনই সময় এসেছে এদের বয়কট করার, বিশেষ করে যারা হাইব্রিড ও অন্য আদর্শ থেকে আওয়ামী লীগে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তাদের আওয়ামী লীগের বয়কট করতে হবে। মূলত যারা ভিন্ন আদর্শের আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে ঘাপটি মেরে তৃণমূলকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তাদের প্রতিহত করতেই আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দলীয় কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষ করে দেখা যায়, একেবারে যারা তৃণমূল থেকে উঠে আসা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, তারা হাইব্রিডদের দ্বারা নানাভাবে নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের দল থেকে বিতাড়নের মোক্ষম মাধ্যম হিসেবে নির্বাচন বেছে নিতে পারে আওয়ামী লীগ। কারণ দলে ভুঁইফোড়, বিষফোঁড়া, হাইব্রিড, ভিন্ন আদর্শের নেতাকর্মীরা জায়গা করে নিলে প্রকৃত আদর্শের কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আওয়ামী লীগের ত্যাগী কর্মীরা; বিজ্ঞ নেতৃত্ব বিভিন্ন সময় আফসোস করে বলেন, দলীয় নেতৃত্ব কিংবা দলের শীর্ষপর্যায়ে এমনকি সংসদেও রাজনীতিবিদের তুলনায় ব্যবসায়ীদের আনাগোনা পরিলক্ষিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। এ জায়গা থেকে আওয়ামী লীগকে রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে রাজনীতিটা মূলত রাজনীতিবিদদের করতে দেওয়া উচিত। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করা উচিত। এখন ব্যবসায়ীরা যদি রাজনীতিতে প্রবেশ করে আসন গড়তে চায়, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের শঙ্কা থেকেই যায়। সে জায়গা থেকে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে। ব্যাপকভাবে যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে প্রকৃত ও ত্যাগী নেতৃত্বের মূল্যায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। আবার দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যখন দলীয় মনোনয়ন প্রদান করে সে জায়গায় হিসাবনিকাশ সমীকরণকে সামনে রেখে প্রার্থীকে মূল্যায়ন করতে হয়; যেখানে দেখা যায় প্রকৃত নেতৃত্ব মূল্যায়নে কাঠখড় পোহাতে হয়। আবার বর্তমান সময়ে মনোনয়ন-বাণিজ্যের বিষয়েও পত্রপত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে। যারা মনোনয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকেন কিংবা মনোনয়ন প্রদানের নিমিত্তে যেসব তথ্য-উপাত্ত বরাদ্দ রাখা জরুরি হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে মনোনয়নে প্রকৃত মানুষ উঠে না আসার পেছনেও তারা জড়িত থাকে। এসব কারণেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিরা অনেক সময় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়।
কাজেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিক পর্যায়ে ব্যাপক তৎপরতা দেখাতে হবে। এ পরিক্রমায় দলের তৃণমূলকে ব্যাপকভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে রয়েছেন, তাদের মূল্যায়ন করতে হবে ভোট প্রদানের মাধ্যমে, দলের জন্য ত্যাগের ইতিহাস যাদের রয়েছে, তাদের অত্যন্ত জোরালোভাবে সামনে নিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান বিভিন্ন আলোচনায় দলের তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতাকে তুলে ধরেছেন, তৃণমূলের ত্যাগের ইতিহাসের বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেছেন। আদতে দলের তৃণমূল কখনো দলের সঙ্গে বেইমানি করে না। তা ছাড়া তৃণমূলই দলের অন্তঃপ্রাণ। তৃণমূলে যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সাংগঠনিকভাবে তাদেরই সমর্থন দিতে হবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যাদের দীর্ঘদিনের ইতিহাস রয়েছে, তাদের মূল্যায়নের অন্যতম উপযোজন হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন।
আওয়ামী লীগের প্রকৃত কর্মীদের মূল্যায়ন করতে পারলে দল সাংগঠনিকভাবে মজবুত হবে, দলের ভিত আরো সুসংহত ও উন্নত হবে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতির আবির্ভাবে দলকে সাংগঠনিক ভিতের ওপর দাঁড় করাতে প্রকৃত কর্মীদের এ নির্বাচনে বের করে নিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগের ছায়াতলে থেকে যারা দলের ক্ষতি করে যাচ্ছে, পালাক্রমে তাদের ব্যাপারে সচকিত থাকতে হবে। তা ছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনে যারা দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তাদের ব্যাপারেও সোচ্চার হতে হবে। বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে যারা দলকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই উত্তম সময়। দলের তৃণমূল ও শীর্ষ নেতৃত্বের উচিত হবে প্রকৃত কর্মীদের ও ত্যাগীদের মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দলীয় ভিতকে মজবুত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে যদি দলীয় মেলবন্ধন নিশ্চিত করা যায়, তাহলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং দেশও অর্থনীতিতে এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতে।
আওয়ামী লীগ বর্তমানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এবং নির্বাচনসমূহে বিএনপি না থাকায় দলটিকে কৌশল অবলম্বন করে এগোতে হচ্ছে। অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ায় দলের মধ্য থেকে অনেকেই প্রার্থী হচ্ছেন এবং নির্বাচন জমজমাট করে তুলেছেন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে; সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে প্রকৃত আওয়ামী লীগের কর্মীকে নির্বাচনে জয়লাভের পেছনে কাজ করে যেতে হবে। জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতির ভিতকে মজবুত করার লক্ষ্যে স্থানীয় নির্বাচন আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
"