reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৬ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

উদাসীনতার কারণে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ড

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনায় জনমনে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। বিশেষত, রাজধানীর সাম্প্রতিক আগুনের লেলিহান শিখা যেন ফুলকি ছড়িয়েছে দেশের প্রতিটি জনপদে, জনমনে। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকাগুলো থেকে শুরু করে শহরের অভিজাত এলাকার অত্যাধুনিক বহুতল ভবন, প্রত্যন্ত গ্রামবাংলা কোনো কিছুই যেন রেহাই পাচ্ছে না ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে। নিমতলী থেকে চকবাজারের চুড়িহাট্টা, আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্ট থেকে টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানা থেকে বনানীর পুড়ে যাওয়া এফআর টাওয়ার থেকে বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটে আগুন।

সবশেষ ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ (বৃহস্পতিবার) রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস জানায়, রাত ৯টা ৫১ মিনিটের দিকে গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটিতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে রাত ৯টা ৫৬ মিনিটের দিকে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করে। পরে আরো চারটি ইউনিট যুক্ত হলে ১২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ছাড়া চিকিৎসাধীন আহতরা কেউ শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. সামন্ত লাল সেন।

উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, আগুন লাগা ভবনটির প্রতিটি তলার সিঁড়ি ছিল বড় বড় গ্যাস সিলিন্ডারে ঠাসা, যা ব্যবহৃত হতো রেস্টুরেন্টে রান্নার কাজে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবহৃত সেসব গ্যাস সিলিন্ডারই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরো ঘটনায়।

আগুনের সূত্রপাত কিংবা ক্ষয়ক্ষতির পুরোপুরি তথ্য কোনো সংস্থা এখনো না দিতে পারলেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ভবনটির নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল কি না- এ বিষয়ে। যদিও সিআইডি বলছে, কেমিক্যাল পরীক্ষা করে উদঘাটন করা হবে দুর্ঘটনার পেছনের কারণ। এই বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন সময় ঘটেছে আরো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এসব ঘটনায় সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি হতাহতের সংখ্যাও কম নয়। সাক্ষী হয়ে আছে আগুনের ভয়াবহতার। বাংলাদেশে অগ্নিঝুঁকি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। যেখানে প্রতি বছরই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি হ্রাস পাওয়ার কথা, সেখানে পরিসংখ্যান দিচ্ছে উল্টো তথ্য।

বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু এর বেশির ভাগই ব্যবহার হয়েছে রেস্তোরাঁ হিসেবে; যা সুস্পষ্টভাবে ইমারত আইন ও নগর-পরিকল্পনার ব্যত্যয়। ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ, একটি জুস বার (ফলের রস বিক্রির দোকান) ও একটি চা-কফি বিক্রির দোকান ছিল। ছিল মোবাইল ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম এবং পোশাক বিক্রির দোকানও। ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তার পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। ভবনের মালিকপক্ষের দায়িত্বহীনতা, ভবনে থাকা রেস্তোরাঁয় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে উদাসীনতার কারণেই অগ্নিকাণ্ডে এত প্রাণহানি হয়েছে। অথচ ভবনটিতে রেস্তোরাঁ করার কোনো অনুমতি ছিল না। আর রাজউক কর্তৃক ভবনটির প্রথম থেকে পঞ্চমতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক (শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে) এবং ষষ্ঠ ও সপ্তমতলা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। ভবনটিতে রেস্তোরাঁ, শোরুম (বিক্রয়কেন্দ্র) বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি। কিন্তু ডেভেলপার কোম্পানি ভবন বুঝিয়ে দেওয়ার পর মালিকরা পুরো ভবনটি বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করছিলেন, যেখানে অনুমোদনহীনভাবে বেশির ভাগই ছিল রেস্টুরেন্ট। মালিকরা বেশি ভাড়ার জন্য এক কাজের জন্য অনুমতি নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করছিলেন। ভবন মালিকদের অতি মুনাফা লাভের প্রবৃত্তি এই আগুনের ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। আর ভবনটিতে কার্যকর কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা ছিল না আর এ দুর্ঘটনার আগে ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ভবন মালিক ও ভবনের ব্যবহারকারীরা। বিপরীতে বারবার নোটিস দিয়েই দায় সেরেছে ফায়ার সার্ভিস। আগুন লাগার পর উত্তাপ আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় ভবনটির ওপরের তলাগুলো।

চিকিৎসকদের ভাষ্য মতে, যারা মারা গেছেন তাদের অনেকে কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিংয়ের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ একটি বদ্ধ ঘরে যখন বের হতে পারে না, তখন ধোঁয়াটা শ্বাসনালিতে চলে যায়। ভবনে জানালা না থাকা এবং পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন তথা বায়ুপ্রবাহের ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের শ্বাসরোধ হয়ে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ছিল একটিমাত্র সিঁড়ি। আর ভবনের একটি ফ্লোর ছাড়া সব ফ্লোরে অপরিকল্পিত উপায়ে এবং বিপজ্জনকভাবে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিল। শুধু গ্রিন কোজি নয়, বেইলি রোডের আশপাশের সব ভবনের প্রায় একই অবস্থা। তাই নগর সংস্থাগুলোর নিয়মিত তদারকি থাকলে এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। তাই এ ধরনের দুর্ঘটনা এলে গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা না করলে এবং এ বিষয়ে যেসব ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, উদাসীনতা ও অন্যায় আচরণ করেছেন, তাদের যথাযথ আইনের আওতায় না আনলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close