reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৬ মার্চ, ২০২৪

বিশ্লেষণ

স্বাধীনতার মাসকে কেন ‘অগ্নিঝরা মার্চ’ বলা হয়

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

শুরু হলো স্বাধীনতার মাস। স্বাধীনতা দিবসের মাস। বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে এই মার্চ মাসকে বলা হয় ‘অগ্নিঝরা মার্চ’। কিন্তু কেন অগ্নিঝরা মার্চ বলা হয় তার কোনো বহুল পরিচিত, সর্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা কেউ কখনো দিয়েছেন কি না- আমার জানা নেই। কিন্তু ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের যে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ, যে জাগরণী ভূমিকা এবং যে উত্তাল আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃৃতি, তা-ই ১৯৭১ সালের মার্চকে একটি ঐতিহাসিক এবং অগ্নিঝরা মার্চের চরিত্র দিয়েছে। কেননা এই মাসেই শুরু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ; ৯ মাসব্যাপী স্বাধীনতার সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বঞ্চনা, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, সামাজিক বৈষম্য ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত ও স্বাধীন করার মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল এ মার্চ মাসেই। এ মাসেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ মার্চ মাসেই ঘটেছিল অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা, যা বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম নেওয়ার পেছনের একটা গৌরবোজ্জ্বল পাটাতন তৈরি করেছিল। ১৯৪৭ সালে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’র ভিত্তিতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের হাত ধরে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে সে দিনই বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত তৈরি হয়েছিল। কেননা হাজার মাইলের ব্যবধানে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে ‘পাকিস্তান’ নামক যে একটি পিকুলিয়ার রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল, সেটার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়া ছিল শুধুই সময়ের ব্যাপার। কেননা, দুটি দেশের মানুষের ভাষা ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান ভিন্ন, জীবনাচার ভিন্ন এবং দর্শন ভিন্ন। অধিকন্তু পশ্চিম পাকিস্তান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে যেভাবে শোষণ, নির্যাতন এবং নিপীড়ন করছিল, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবি শুধুই সময়ের ব্যাপার ছিল। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে এসব নিপীড়ন, নির্যাতন এবং শোষণের প্রাথমিক প্রতিবাদ ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও সেটা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে মূলত ১৯৭১ সালের এ মার্চ মাসে। যেহেতু মার্চ মাসেই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়, সেহেতু মার্চই হয়ে উঠে স্বাধীনতার মাস। হয়ে উঠে অগ্নিঝরা মার্চ।

পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক যে নিপীড়ন, বৈষম্য ও অত্যাচার জারি ছিল সেটার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আসে মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এরপর আসে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের ২৪ বছরের মিনি-ঔপনিবেশিক শাসনামলের যে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা, যা ১৯৫২ থেকে ১৯৭১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত, তার মধ্যে মার্চ মাসে এসেই প্রকৃতার্থে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বিশেষ করে মার্চ মাসকে ‘অগ্নিঝরা মার্চ’ হিসেবে ভূষিত করার পেছনে যেটি প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে সেটি হচ্ছে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ যেখানে বাঙালিদের মধ্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্নকে বাস্তবায়নের যে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে একটা তীব্র প্রতিরোধ এবং প্রতিরোধ করার সাহস জাগানিয়া অনুপ্রেরণা নিহিত ছিল। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যখন বলছেন, ‘তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো- তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।... এবং রাস্তাঘাট যা কিছু আছে, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ শেষ করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তখনই মূলত অগ্নিঝরা মার্চ শুরু হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ঝরেছিল প্রতীকী অগ্নি, যা ৭ কোটি বাঙালির মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল।

তবে ২৫ মার্চের কালরাত্রির সেই ভয়াবহ ‘অপারেশন সার্চলাইট’র ঘটনাকেও এখানে উল্লেখ করা জরুরি। পাকিস্তানের সশস্ত্র সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ জনগণের ওপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং আবালবৃদ্ধবনিতাকে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেছিল, সেটাও সংঘটিত ও শুরু হয়েছিল এ মার্চ মাসেই। এই ন্যক্কারজনক হত্যাযজ্ঞ কুখ্যাত জেনোসাইড হিসেবে পরিচিত। এ হত্যাযজ্ঞ মুক্তিকামী বাঙালিদের দমাতে তো পারেইনি; বরং আরো তেতিয়ে তোলে। এরপর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রামের এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন এবং বাংলার দামাল ছেলেরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, যুবক, মেহনতি মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমজীবী এবং বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ দলমত-নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে। সশস্ত্র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে তীব্র প্রতিরোধ এবং প্রতিহত করার দৃঢ় প্রত্যয় দৃশ্যমান হয় এ মার্চ মাসেই। তাই মার্চ স্বাধীনতার মাস হিসেবে স্বীকৃতি পায়, কেননা স্বাধীনতাসংগ্রামের সত্যিকার সূত্রপাত হয় এ মার্চ মাসেই।

দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলা এই মুক্তির সংগ্রামে ৩০ লাখ শহীদ রক্ত দিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে। সঙ্গে ছিল এসব হানাদারদের দোসর এ দেশেরই রাজাকার, আলবদর এবং আলশামস। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে জন্ম লাভ করে। এ দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের মূল সূত্রপাত ঘটে মার্চ মাসে। ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল; আমরা তার প্রতিবাদ করে বাংলা ভাষাকে, আমাদের মাতৃভাষাকে, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম কিন্তু পাকিস্তান এখানে দমে যায়নি। তবে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা হলেও তার মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের মধ্যে বাঙালির জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচিন্তা তীব্রভাবে বিকশিত হতে থাকে, যার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ১৯৫২ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত একটি জাতিকে সুনিপুণভাবে নেতৃত্ব দিয়ে তার ভেতরে আস্তে আস্তে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন পুঁতে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সে স্বাধীনতার স্বপ্ন লালিত-পালিত হয়েছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রজন্মের পর প্রজন্মের মনে, মননে, চিন্তায় ও বিশ্বাসে যার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৭১ সালের মার্চে এসে। মার্চ মাসেই শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম, যা ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে গিয়ে একটি চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে।

তাই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসকে বলা হয় স্বাধীনতার মাস। বলা হয় ‘অগ্নিঝরা মার্চ’। আজকের প্রজন্মকে এ সত্যটি জানতে হবে এবং জানাতে হবে যে মার্চ শুধু ১২ মাসের একটি সাধারণ ‘মাস’ নয়, এটি সত্যিকারের একটি ‘অগ্নিঝরা মার্চ’ এবং কেন এ মাসটি ‘অগ্নিঝরা’ সেটা বোঝাতে হবে। কেননা এ অগ্নিঝরা মার্চ মাসের মর্মার্থের ভেতরেই লুকায়িত আছে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার সবিস্তার ইতিবৃত্ত।

লেখক : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close