ছায়েদ আহমেদ

  ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

হাতিয়ায় শিক্ষাব্যবস্থার অতীত-বর্তমান প্রেক্ষিত

এ অঞ্চলের বিদ্যাপীঠগুলোতে একসময় নিষ্ঠা, একাগ্রতা এবং মূল্যবোধ ছিল জাগ্রত। আর্থিক টানাপড়েন শিক্ষার পথে বাধার কারণ ছিল না। কালপরিক্রমায় এখন তা বাণিজ্যিক, দায়সারা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। শিক্ষাব্যবস্থার এ যুগের মনগড়া কৌশল, অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনা কিংবা পড়াশোনার সহজপ্রাপ্যতা প্রভৃতির দরুন শিক্ষার্থীরা ‘সাধনা’ বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত হতে পারছে না। যেমনটি এনালগ যুগে ছিল বলে আমরা জানি।

ঐতিহাসিক সূত্র মতে, দ্বীপাঞ্চল হাতিয়ার বয়স প্রায় ৫ হাজার বছরের অধিক হলেও, হাতিয়ায় শিক্ষার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু এই তো কিছুদিন আগে অর্থাৎ ১৮৮০ সালের দিকে অথবা এর কিছু আগে-পরে। প্রথমদিককার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘হাতিয়া শিশুপাঠ’, ‘জগমোহন স্কুল’। তখনকার জ্ঞানপিপাসুদের হাতে গড়ে উঠেছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এসব প্রতিষ্ঠান বেশিদিন টিকেনি। মূলত হাতিয়ায় শিক্ষা বিস্তার শুরু হয় ১৯১২ সালে ‘হাতিয়া ইউনিয়ন মডেল পাইলট উচ্চবিদ্যালয়’ এবং এর কিছুদিন পর ‘রহমানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ ছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালী, মানবিক এবং দানশীল ব্যক্তিদের দয়ায় মক্তবভিত্তিক এবং জাগিরভিত্তিক পড়াশোনা চলে আসছে। কথা হচ্ছে, যখন থেকে এই যে শিক্ষার বীজ বপন হলো এরপর থেকে হাতিয়ার শিক্ষা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল! দেশের নামকরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতিয়ার শিক্ষার্থীরা জ্যোতি ছড়াতে থাকে।

কিন্তু বিগত এক যুগ ধরে শিক্ষার গুণগত মান একেবারে তলানিতে; এর বহুবিধ কারণ উল্লেখ্য-

প্রথমত : ক্রমানুপাতিক হারে বাড়ানো হচ্ছে পাসের হার, সেই সঙ্গে জিপিএ ৫-এর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। পরীক্ষার হলগুলোতে অসদুপায় এবং বাইর থেকে সাপোর্ট দিয়ে দিন দিন এ অবস্থার আরো অবনতি ঘটানো হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত : যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে প্রায় সবাই স্মার্টফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নানা নেশাময় মগ্ন হয়ে গেছে। হাতিয়ার স্কুল-মাদরাসাভিত্তিক চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জরিপে উঠে আসে- অধিকাংশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট রয়েছে বা আনাগোনা রয়েছে। শতকরা হিসাবে প্রায়ই ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর অ্যাকাউন্ট আছে। এদের মধ্যে কারো একটা, কারো দু-তিনটাও আছে।

তৃতীয়ত : মাধ্যমিকপর্যায়ে রাজনীতির যে ছড়াছড়ি তার সরাসরি প্রভাব শিক্ষার ওপর ফেলছে। উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীদের মনে ক্ষমতার একটা দাম্ভিকতা চলে আসে, যা আসলেই ভয়ানক, তারা ধূমপান, ইভটিজিংসহ যেকোনো নিন্দনীয় কাজ করতে দ্বিধা করে না।

চতুর্থত : হাতিয়ায় সব মিলিয়ে খারাপ অবস্থানে আছে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা। যার সূচনা প্রাথমিক পর্যায় থেকে।

২০২৪ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় মাসেও পাঠদানে মনোযোগী হতে দেখা যায়নি কোথাও। বিদ্যালয় মাঠে খেলাধুলা, দুষ্টমি, অ্যাসেম্বলি আর দুপুর হতে না হতে গৃহে ফিরতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক জানান, অনেক শিক্ষক ঠিকমতো স্কুলে আসেন না, আসলেও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে চলে যান। মাধ্যমিকের ক্লাসরুটিন করতে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা বছরের ৪ থেকে ৫ মাস সময় লাগিয়ে দেন। চলমান পদ্ধতির টিজির (শিক্ষক গাইড) ফলে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকলে সেই শ্রেণি কার্যক্রমও চরমভাবে ব্যাহত হয়।

হাতিয়ার অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘুরে লক্ষ করা গেছে, বেশির ভাগ শিক্ষকই স্কুল এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবে না। স্কুলে এসে নিজেদের সাংসারিক প্রলাপ করে। দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া এখানে একদিকে নেই যেমন ভালো শিক্ষক, তেমনই অন্যদিকে নেই সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পনা। যথারীতি পাঠদানের চেয়ে এখানে ঐতিহ্যের নাম বেচে কিছু প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট শিক্ষা নিয়ে বেশি আগ্রহী। আগ্রহ এমন পর্যায়ে গেছে, প্রাইভেট এখন বাণিজ্যিক রূপ ধারণ করেছে। ক্লাস থেকে প্রাইভেটে

বেশি গুরুত্ব দেয় তারা। করোনাকালীন সময়ে

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও দেদার চলছিল প্রাইভেট বাণিজ্য। সেই থেকে শিক্ষকদের একাংশের মনে লোভ প্রবলভাবে দানা বাঁধে।

ছাত্ররা যেমন নোংরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তেমনি দিন দিন শিক্ষকরাও এর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। এজন্য তারাও স্কুল-ছাত্র-শিক্ষকতা নিয়ে কিংবা শিক্ষার মান নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

উপরোল্লিখিত সব কারণের সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিক্ষার ক্রমহ্রাসমান অবস্থার ওপর। যেমন : গত এইচএসসি পরীক্ষা-২০২৩-এ হাতিয়ার একমাত্র সরকারি উচ্চ বিদ্যাপীঠ হাতিয়া দ্বীপ সরকারি কলেজে মারাত্মক ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে। কলেজটির ৩১৬ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে মাত্র ৭৫ জন। এ ছাড়া ২০২১-২২ খ্রিস্টাব্দে হাতিয়া থেকে মাধ্যমিক পাসের পর নটর ডেম, হলিক্রস এবং সেন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় টিকেছে মাত্র ৬-৭ জন। ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া ৭৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন মাত্র টিকেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। কিন্তু এর কয়েক বছর আগেও দেশসেরা সব কলেজে হাতিয়ার শিক্ষার্থীদের বিচরণ ছিল লক্ষণীয়ভাবে।

পরীক্ষার হলের অবস্থা যদি হাতিয়ার বাইরের শহরাঞ্চলের মতো কড়াকড়ি হতো- তাহলে বোধহয় যে কয়টা এ+ আসে সে কয়টা পরীক্ষার্থী পাস করত কি না সন্দেহ। শিক্ষার নিম্নমুখী এমন অবস্থার পাশাপাশি সমান তালে অধঃপতন হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধেরও।

এই তো গেল সমস্যার কথা। সমস্যা উত্তরণের নানা উপায় উল্লেখ্য-

-শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের প্রাইভেটবিমুখীকরণ এবং ক্লাসমুখীকরণ অন্যতম প্রধান সমাধান। ক্লাসে ছেলেমেয়েরা দিনের সর্বোচ্চ সময় পার করে, সেখান থেকে শেখার সুযোগ হচ্ছে বেশি। কিন্তু প্রাইভেটে সময়কাল মাত্র ৪০-৪৫ মিনিট, সেখানে তেমন কিছু শেখানোর সুযোগ হয়ে উঠে না।

-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে যে অসামাজিক প্রজন্ম সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা ঠেকানোর জন্য বাবা-মাসহ সব অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। শিক্ষাসহায়ক হিসেবে স্মার্টফোনের প্রয়োজনীতা হ্রাস করতে হবে কেন্দ্রীয়ভাবে।

-ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও অন্তত মাধ্যমিকপর্যায়ে রাজনীতি শিক্ষার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই

অবুঝ শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক পদ পেয়ে মনে করছে- এসব হচ্ছে তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ফলে তারা ধূমপান,

ইভটিজিংসহ নানা রকম অপকর্মে নিজের অজান্তেই জড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে এসব থেকে তাদের ফেরাতে অভিভাবকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। তবেই সুখকর সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে বলে মনে করি।

লেখক : সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close