শরীফ উল্যাহ

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

প্রচেষ্টা ও অনুপ্রেরণার কিছু গল্প

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় ইউএনও হিসেবে যোগদানের পর থেকেই মাধ্যমিকপর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ইংরেজিভীতি, জড়তা ও দুর্বলতা দূর করে তাদের আত্মবিশ্বাসী, সাহসী ও দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘এভরিডে ফাইভ ওয়ার্ডস’ কার্যক্রম শুরু করি। তারই ধারাবাহিকতায় পরে চার পর্বের ‘মভ টেস্ট’ অর্থাৎ ‘মাস্টার অব ভোকাবুলারি’ পরীক্ষার আয়োজন করি। ধাপে ধাপে এই পরীক্ষা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে থাকে। অনেক কষ্ট ও ত্যাগস্বীকার করে শিক্ষার্থীরা চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়। নিশ্চয়ই প্রত্যেক বিজয়ী শিক্ষার্থীর রয়েছে সাফল্যের পেছনের গল্প! আমার জানা অগণিত গল্প থেকে কয়েকটি গল্পের সার-সংক্ষেপ সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণার জন্য এখানে তুলে ধরলাম :

১. ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখ এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার্থীদের ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের জন্য আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘ইউসেট’ পরীক্ষার দিন শাহপীর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ছিলাম। বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে বসা অবস্থায় আমার কাছে এক ভদ্রলোক এসে হাজির। সালাম দিয়ে পরিচয় দিলেন। তিনি পিংকির বাবা। পিংকির পুরো নাম তাছমিন সোলতানা পিংকি। তিনি বললেন, ‘স্যার আমি বিদেশে থাকি। আমি আসলে আপনাকে সালাম ও ধন্যবাদ জানাতে এসেছি। আমার ছোট মেয়ে পিংকি মোস্তফা বেগম গার্লস স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। সে আপনার মভ টেস্টে চূড়ান্তভাবে সমগ্র উপজেলায় প্রথম হয়েছে। তার জন্য দোয়া করবেন, স্যার। এই পরীক্ষাগুলোর জন্য সে অনেক কষ্ট করেছে। কষ্টের ফলও পেয়েছে। আর আমার বড় মেয়েটাও আপনার ইউসেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে।’ বললাম, আপনাকে ও আপনার মেয়ে পিংকিকে অভিনন্দন। খুবই ভালো লাগল। তা আপনার ছোট মেয়ে এই অর্জনের জন্য কেমন পড়াশোনা করেছে, বলুন তো! তখন তিনি বললেন, স্যার, মেয়েটা গত ৩-৪ মাস রাতে ঘুমায়নি বললেই চলে! শুধু পড়াশোনার মধ্যে ছিল। ক্লাসের পড়ার পাশাপাশি বিশেষ করে আপনার দেওয়া শব্দগুলো অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়েছে। এতে তার অনেক উপকার হচ্ছে। পিংকির বাবার মুখে এমন কথা শুনে খুবই ভালো লাগল। পিংকি গত বছর ক্লাস সেভেনে উপজেলাপর্যায়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার জিতেছে। এ বছর এক দিন তাদের ক্লাসে উপস্থিত প্রতিযোগিতায়ও সে পুরো নম্বর পেয়ে উইনার্স ব্যাগ পুরস্কার জিতেছে। এবারও সে মভ টেস্টে ক্লাস এইট থেকে ২য় পর্বে উত্তীর্ণ হয়েছে। পিংকির এই পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই তাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে!

২. দেবাশীষ আচার্য্য, সহকারী শিক্ষক, সুখছড়ি উচ্চবিদ্যালয়। তার মেয়ে প্রজ্ঞা প্রদীপ্তা আচার্য্য। ২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। উপজেলায় যোগদানের পর থেকেই শুনেছি- মেয়েটা অত্যন্ত মেধাবী। সব বিষয়েই ভালো। যেকোনো প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কার জিতে। জাতীয় শিক্ষক দিবস-২০২২-এ আমার হাত থেকে অনেকগুলো পুরস্কার নিয়েছে। এক দিন তাদের স্কুলে তার ক্লাসে কিছুক্ষণ ক্লাস নিলাম। তখন বললাম, আগামীতে আমার কয়েকটি প্রতিযোগিতা হবে। সেগুলো কঠিন হবে। তোমাকে সেগুলোতেও ভালো করতে হবে। ভালো করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বলে আমাকে কথা দিয়েছে। মেয়েটি কিন্তু কথা রেখেছে। ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত মভ টেস্টে সমগ্র উপজেলায় দশম শ্রেণিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনসহ অন্যসব প্রতিযোগিতায় সে অত্যন্ত ভালো করে পুরস্কার জিতেছে। তার এবং তার বাবার বক্তব্য মতে, ‘এভরিডে ফাইভ ওয়ার্ডস’ ও ‘মভ টেস্টের’ ফলে অ্যাকাডেমিক অন্য পড়াশোনার পাশাপাশি মাত্র চার মাসেই প্রায় ৩০০০ থেকে ৩৫০০ হাজার নতুন ইংরেজি শব্দার্থ ভালোভাবে আয়ত্ত করেছে এবং সেগুলোর ব্যবহারও শিখেছে প্রজ্ঞা! যা সত্যিই বিস্ময়কর! প্রজ্ঞা এসএসসি পরীক্ষায়ও অসাধারণ ফলাফল করেছে। এখন চট্টগ্রামে হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে পড়ছে। প্রজ্ঞার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

৩. মোস্তফা বেগম গার্লস স্কুলের শিক্ষক মোক্তার আহমেদ। তার মেয়ে মুশফিকা মেহজাবীন, দক্ষিণ সাতকানিয়া গোলাম বারী সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে ক্লাস নাইনের শিক্ষার্থী ছিল। মভ টেস্টের চূড়ান্ত মূল্যায়নে উপজেলায় শুধু নবম শ্রেণি নয়, সব শ্রেণির মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে পুরস্কার জিতেছে। তার বাবা-মা তার সাফল্যে অনেক খুশি। তবে এতটুকু সাফল্যের জন্য মেয়ের অনেক পরিশ্রম তারা কাছ থেকে দেখেছেন। উপজেলায় শ্রেষ্ঠ হতে পেরে মুশফিকা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। ইংরেজি এখন তার জন্য খুবই সহজ বিষয়ে পরিণত হয়েছে! সে মভ টেস্টের জন্য আমাকে ইংরেজিতে লেখা একটি ধন্যবাদপত্রও পাঠিয়েছে। মুশফিকার জন্য অনেক অনেক দোয়া।

৪. জারিন তাসনিম তিহা, কলাউজান ডা. এয়াকুব বজলুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে ২০২২ সালে মভ টেস্টের চূড়ান্ত মূল্যায়নে ক্লাস সেভেনে সমগ্র উপজেলায় ২য় স্থান অর্জন করে পুরস্কার জিতেছে। পরে আবার এক দিন তাদের স্কুল পরিদর্শনকালে ক্লাসে উপস্থিত প্রতিযোগিতা আয়োজন করলে সেখানেও ভালো করায় উইনার্স ব্যাগ জিতেছে। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত মভ টেস্টের ১ম ও ২য় পর্বেও খুব ভালো করেছে। জারিনের এই প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই বৃথা যাবে না।

৫. কিছুদিন আগে মাদরাসার এক শিক্ষকের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, স্যার, আমার মেয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ে। এবার আপনার মভ টেস্টে ২য় পর্বে পরীক্ষা দেবে। বললাম, খুবই ভালো। তা, ১৯ অক্টোবর ২য় পর্বের পরীক্ষার জন্য সে কেমন প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি বললেন, ‘স্যার ব্যাপক পড়াশোনা চলছে। আমাকে শুধু বলে, বাবা আমাকে কী কী পড়তে হবে দিয়ে দাও। খুব পড়তেছে। দোয়া করবেন, স্যার। বললাম, অবশ্যই। শুনে খুবই ভালো লাগল।

৬. কলাউজান ডা. এয়াকুব বজলুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইস্পা বিনতে ইসলাম ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত মভ টেস্টের ১ম পর্বের পরীক্ষায় সমগ্র উপজেলায় শুধু নবম শ্রেণি নয়, সব ক্লাসের মধ্যে একমাত্র সে-ই ৩৫ নম্বরের মধ্যে ৩৫ পেয়ে সমগ্র উপজেলায় হইচই ফেলে দিয়েছে। সে ক্লাসে উপস্থিত প্রতিযোগিতায়ও উইনার্স ব্যাগ জিতেছে। ইস্পা নিশ্চয়ই এখন অনেক দূরে চোখ রাখছে! তার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

৭. এসআই চৌধুরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে তিনজন শিক্ষার্থী ২০২২ সালে ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য নির্ধারিত তিনটি পুরস্কারই জিতেছে। ২০২৩ সালে নির্ধারিত সংখ্যার কারণে সপ্তম শ্রেণি থেকে তাদের মাত্র দুজন চান্স পেয়েছে দ্বিতীয় পর্বে। রেজাল্টের পর পাঁচজন অভিভাবক স্কুলে এসেছেন এবং আমাকেও ফোন করেছেন। তারা বললেন, মেয়েরা এত ভালো পড়াশোনা করেও দ্বিতীয় পর্বে চান্স পেল না কেন? মেয়েরা ৩৫-এর মধ্যে ৩৩ বা ৩৪ পেতে পারে! মেয়েরা পুরাই আত্মবিশ্বাসী। বললাম, খাতা দেখে জানাচ্ছি। পরে দেখলাম, পাঁচজনের খাতার মধ্যে চারজন পেয়েছে ৩৩ করে আর একজন পেল ৩০! যদিও রোল নম্বর পরে হওয়ায় আমাদের শর্ত ও সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের দ্বিতীয় পর্বে সুযোগ দিতে পারিনি। অথচ চান্সপ্রাপ্ত দুজনই ৩৩ করেই পেয়েছে! তাহলে তারা কতটা কষ্ট করেছে এবং মা-বাবা কতটা সচেতন ও আন্তরিক তা স্পষ্ট বোঝা যায়! এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে তারা নিশ্চয়ই অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

গল্প আরো অনেক আছে! তবে সব গল্প এই লেখায় লেখা সম্ভব নয়। লোহাগাড়ায় আমার সময়কালে এ রকম শত শত গল্প তৈরি হয়েছে। আমি চাই এই গল্পগুলো থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সাফল্যের গল্প তৈরি হোক। ‘এভরিডে ফাইভ ওয়ার্ডস’ এবং ‘মভ টেস্ট’ মূলত ইংরেজিতে শিক্ষার্থীদের ভয়, জড়তা ও দুর্বলতা দূর করার উপায় ছিল মাত্র। যারা কঠোরভাবে এই উপায় অবলম্বন করেছে তারা ঠিকই ইংরেজিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং নিঃসন্দেহে এগিয়ে যাবে আরো অনেক দূর! এ কথা অনস্বীকার্য! সারা দেশের শিক্ষার্থীরাও নিশ্চয়ই এই গল্পগুলো থেকে অনুপ্রেরণা পাবে এবং তারাও ইংরেজি চর্চা ও অন্যান্য পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

লেখক : নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, সুনামগঞ্জ, সিলেট

সাবেক ইউএনও, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close