ইলিয়াজ হোসেন রানা

  ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

৭১ সালে ইয়াহিয়া, নিক্সন ও কিসিঞ্জারের লজ্জার ইতিহাস

জার্মানির বাভারিয়া অঙ্গরাজ্যের ফুর্থ শহরে ১৯২৩ সালের ২৭ মে একটি জার্মান ইহুদি পরিবারে আলফ্রেড কিসিঞ্জারের জন্ম। তার সেই জন্মগ্রহণের মধ্যে কোনো বিশেষত্ব ছিল না। কারণ, সেদিন তিনি সাধারণ একটি পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যখন ১০০ বছর বয়সে মারা গেলেন, তখন তো তাকে আবার আলোচনায় নিয়ে এসেছে। ১৯৩৮ সালে নাৎসি জার্মানির ইহুদি নিধন থেকে বাঁচতে ১৫ বছর বয়সে তার পরিবারের সঙ্গে তিনি নিউইয়র্কে পালিয়ে যান। মাতৃভাষা জার্মানকে অটুট রেখেই কিসিঞ্জার মার্কিন নাগরিক হেনরি হয়ে ওঠেন। ১৯৪৩ সালে ২০ বছর বয়সে সেনাবাহিনী তাকে প্রশিক্ষণের জন্য যুক্ত করে এবং ওই বছরে তাকে জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের দখলে থাকা এলাকায় পাঠিয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কিসিঞ্জার ১৯৫০ সালে স্নাতক এবং ৫২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি পড়াশোনার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাইকোলজি স্ট্র্যাটেজি বোর্ডের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। যেসব দেশে সমাজতন্ত্র ছিল, সেসব দেশে গণতন্ত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্য ১৯৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ওই বোর্ড গঠন করেছিল। এটি হচ্ছে সেই সময়, যখন যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়ায় অভিযান চালিয়ে লাখ লাখ কোরীয় নাগরিককে হত্যা করেছিল। ১৯৫৭ সালে ‘নিউক্লিয়ার উইপনস অ্যান্ড ফরেন পলিসি’ নামে কিসিঞ্জার একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে জয় নিশ্চিত করতে নিয়মিত ভিত্তিতে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। মানুষ হত্যার এই ধরনের প্ররোচনা দেওয়ার কারণে সমালোচকরা তার নাম দিয়েছিলেন, ডক্টর ‘হেনরি কিলিঞ্জার’।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলা বাড়িয়েছিলেন। জনসনের আমলে কম্বোডিয়ার বোমা ফেলা শুরু হয়েছিল। কিসিঞ্জার এসে ১৯৭৩ সালে কার্পেট বোমা ফেলা শুরু করেন। যাতে কমপক্ষে দেড় লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল। ওই বোমা হামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনা শুরু হলে, কিসিঞ্জার একবার শক্ত হয়ে বলেছিলেন, আমার মনে হয় কম্বোডিয়ানদের নিয়ে সমালোচকরা খুব বেশি মাতামাতি করছেন। মার্কিন নথি বলেছে, কিসিঞ্জার কোথায় কতগুলো বোমা দিতে হবে, কোথায় কতগুলো বোমা ফেলতে হবে তার ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন। এই বোমাবাজি তাকে নেশার মতো পেয়ে বসেছিল।

তিনি এবং নিক্সন যখন উত্তর ভিয়েতনামে বোমা হামলা শুরু করেছিলেন, তখন কিসিঞ্জার বোমার ক্রেটের সাইজ দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ায় এক নায়ক সুহার্তোকে পূর্ব তিমুরে গণহত্যা চালাতেও মদদ দিয়েছিলেন কিসিঞ্জার। একইভাবে পৃথিবীর বহু দেশে বহু গণহত্যার নেপথ্যে ছিলেন তিনি। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, সেই কিসিঞ্জার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম থেকে ওবামা, বুশ থেকে বিল ক্লিনটন প্রত্যেকের সঙ্গে কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিল। আজকের ফিলিস্তিনের যে দুর্দশা তার প্রধান ছিলেন এই কিসিঞ্জার। মূলত তার পরিকল্পনাতেই ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের দমননীতি ও পশ্চিমতীরে ইহুদি বসতি স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ভিত্তি তিনি গড়ে দিয়েছিলেন।

কারো চোখে কিসিঞ্জার ‘বাস্তববাদী সফল কূটনৈতিক’ আবার কারোর চোখে তিনি একজন ‘ঠাণ্ডা মাথার খুনি’। যুদ্ধ অপরাধী হিসেবে কিসিঞ্জারকে যারা বিচারের কাঠগড়ায় তোলার দাবি তুলেছেন, ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক ক্রিস্টোফার তাদের অন্যতম। ২০০১ সালে প্রকাশিত তার ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ গ্রন্থে তিনি তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ছয়টি অভিযোগ তোলেন। এক. ষাট ও সত্তরের দশকে ইন্দোচীনে নিরপরাধ নাগরিকদের সুপরিকল্পিত হত্যায় মদদ। দুই. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যায় সমর্থন ও সাহায্য। তিন. ১৯৭৩ সালে চিলির সামরিক অভ্যুত্থান ও বামপন্থি রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যায় নীলনকশা প্রণয়ন। চার. সাইপ্রাসে আর্চবিশপ ম্যাকারিয়াসের হত্যা পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ। পাঁচ. পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনীর হাতে গণহত্যায় সাহায্য। ছয়. ওয়াশিংটন ডিসিতে এক সাংবাদিক হত্যায় ভূমিকা।

নিজের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে কিসিঞ্জার কতদূর যেতে প্রস্তুত ছিলেন তার এক বড় উদাহরণ বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সময় হেনরি কিসিঞ্জার ও রিচার্ড নিক্সনের ভূমিকা কী ছিল, তা দিয়েই কিসিঞ্জারকে মনে রাখবেন দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের ভারত ছেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের। ভৌগোলিকভাবে তখন পাকিস্তানের দুটি অংশ। এই দুই অংশের মধ্যে দূরত্ব ছিল হাজার মাইল। এই দুই অংশের মাঝখানে ছিল ভারত। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জেনারেলের অধিকাংশই ছিল জাতিগতভাবে পাঞ্জাবি। তারা দেশের পূর্ব অংশের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অবজ্ঞা করত। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত হন বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবিরা নির্বাচিত বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গরিমসি শুরু করে। এতে শুরু হয় এক রাজনৈতিক সংকট। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়েছে, এ তথ্য কিসিঞ্জারের অজানা ছিল না। তখন মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘নিউইয়র্ক টাইমস’র দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন সিডনি শ্যানবার্গ।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষদিকে পূর্ব পাকিস্তানের শুরু হওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘বিস্তৃত পরিসরে একটি গণহত্যা’ বলে বর্ণনা করে শ্যানবার্গ বলেছিলেন, সেই ভূমিতে (পূর্ব পাকিস্তানে) মৃতদেহ খেয়ে শকুনরাও মোটা হয়ে উঠছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একের পর এক গ্রাম, জনশূন্য হয়ে পড়েছে নগরের পর নগর। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের এই হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি নিয়ে দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম : ‘নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড’ নামে দারুণ একটি বই লিখেছেন গ্যারি ব্যাস। গ্যারি ব্যাস তার বইয়ে লিখেছেন, চলমান সেই গণহত্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকার পরও গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাঙালিদের গণহত্যা, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর হাতে পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয় পর্যন্ত নিক্সন ও কিসিঞ্জার পাকিস্তানের পক্ষে অনড় অবস্থানে ছিলেন। গ্যারি ব্যাস তার বইয়ে আরো তুলে ধরেছেন, বাস্তববাদী রাজনীতির এই ধ্বজাধারীরা প্রায়ই কীভাবে আবেগতাড়িত হয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি তাদের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছিল।

২৫ মার্চের গণহত্যার সময় কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা। ২৮ মার্চ ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড এক টেলিগ্রামে হোয়াইট হাউসকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ‘ভীতির রাজত্ব’ কায়েম হয়েছে বলে যে সতর্কবার্তা প্রেরণ করেন, পরদিন সকালেই সে তথ্য তার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। এক দিন পর দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিং ‘নির্বাচিত গণহত্যা’ শিরোনামে এক টেলিগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহকৃত অস্ত্র দিয়ে নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে জড়িত এ কথা জানিয়ে অনুরোধ রাখলেন, ‘নীতির ভিত্তিতে কর্মপন্থা নির্ধারণের এখনই সময়’। এক সপ্তাহ পর ৬ এপ্রিল ঢাকা থেকে ২১ জন মার্কিন কূটনীতিক এক যৌথ টেলিগ্রামে বাংলাদেশে গণহত্যায় মার্কিন নীরবতায় তাদের ভিন্ন মত জানিয়ে এক কঠোর বার্তা পাঠালেন। স্বাক্ষরকারীদের একজন ছিলেন আর্চার ব্লাড। তারা পাকিস্তানের পক্ষেই থাকবেন, বাঙালিদের নয়, নিক্সন ও কিসিঞ্জার এই সিদ্ধান্ত এক বছর আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৭০ সালের ২৫ অক্টোবর হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি এক বৈঠকে সে সিদ্ধান্ত তারা নেন। প্রতিশ্রুতি আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব, নিক্সন, ইয়াহিয়াকে জানিয়েছিলেন। ১৩ মার্চ ১৯৭১ নিক্সনের কাছে এক মেমোতে তিনি পরামর্শ দিলেন, পাকিস্তানের ঐক্যের স্বার্থে আমাদের উচিত ইয়াহিয়ার সঙ্গে থাকা। ঢাকা থেকে সামরিক অভিযানের খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার বদলে খুশি হলেন কিসিঞ্জার।

২৯ মার্চ নিক্সন জানালেন, মনে হয় ইয়াহিয়ার গৃহীত ব্যবস্থায় কাজ হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা এখন ইয়াহিয়ার নিয়ন্ত্রণে। সে কথা শুনে নিক্সনের জবাব ছিল চমৎকার। মাঝেমধ্যে শক্তির ব্যবহার কাজে লাগে, সে কথায় মাথা নাড়লেন কিসিঞ্জার। ১৯ এপ্রিল এক মেমোতে কিসিঞ্জার লিখলেন, পাকিস্তানের প্রতি সাহায্য বন্ধের যে দাবি উঠেছে, তিনি তার বিরুদ্ধে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ভেতরেই তার কথার প্রতিবাদ উঠল, নৈতিক কারণে হলেও পূর্ব পাকিস্তানের হত্যাকাণ্ড বন্ধে ইয়াহিয়াকে নিরুৎসাহিত করার দাবি করলেন বিভাগীয় কর্মকর্তারা। সব বাতিল করে দিলেন কিসিঞ্জার। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তার যুক্তি ছিল, এর ফলে ভারতকে সাহায্য করা হবে। ৩১ জুলাই ১৯৭১ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সভায় দাবি উঠল ইয়াহিয়াকে বলা হোক, তিনি যেন পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক দায়দায়িত্ব থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে আনেন।

এ কথা শুনে কেঁপে উঠলেন তিনি, ‘ইয়াহিয়া কীভাবে দেশ চালাবেন, তা নিয়ে আমাদের এত মাথা ব্যথা কেন?’ পাকিস্তানের সমর্থনে কিসিঞ্জার আরো একটি ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিলেন। মার্কিন কংগ্রেস আগেই পাকিস্তানকে কোনো অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সে কথা অগ্রাহ্য করে কিসিঞ্জারের পরামর্শে নিক্সন জর্ডানের মাধ্যমে যুদ্ধবিমান ব্যবহারের নির্দেশ দেন। ব্যাপারটা বেআইনি, খবরটা জানাজানি হলে তিনি বিপদে পড়বেন, সে কারণে নিক্সন কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। কিসিঞ্জার তাকে আশ্বাস দিলেন, যদি এই তথ্য ফাঁস হয়, তো আমরা সাফ অস্বীকার করব। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে দীর্ঘ সময় পাকিস্তানি সেনারা টিকে থাকতে পারবে না, এ কথা কিসিঞ্জার ও নিক্সনের অজ্ঞাত ছিল না। শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা বঙ্গোপসাগরে ভারত বাংলাদেশ নৌ-সীমানায় আনবিক অস্ত্র সজ্জিত সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। কোনো ব্যবস্থাই কাজে লাগেনি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইয়াহিয়া-কিসিঞ্জার-নিক্সন ঠেকাতে পারেননি।

লেখক : প্রভাষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close