মো. জিল্লুর রহমান

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

আফিম থেকে ডালিম, আফগানদের সফলতার গল্প

যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অর্থনীতির চাকা দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখছে কৃষি। ডালিম বা আনার চাষ আফগানিস্তানের অন্যতম কৃষি। দেশটিতে প্রচুর পরিমাণ ডালিম চাষ হয়। এ ফল উৎপাদন ও রপ্তানিতে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম আফগানিস্তান। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানের তালেবান ইসলামি ইমারত সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটি যেসব সেক্টরে উন্নতি লাভ করেছে, তার মধ্যে জুস ও কোমলপানীয় অন্যতম। ইমারত সরকারের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একের পর এক কোমলপানীয়ের প্রোডাক্ট উন্মোচন করা হচ্ছে এবং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে।

সম্প্রতি আফগানিস্তান বিশ্ব র?্যাংকিংয়ে সেরা মুদ্রার খেতাব অর্জনের পর এবার ফলের জুস উৎপাদনেও বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করেছে। সেপ্টেম্বর ২০২৩ প্রান্তিকে বিশ্ব র?্যাংকিংয়ে আফগানি সেরা মুদ্রার খেতাব অর্জনের পর ডিসেম্বর ২০২৩ প্রান্তিকে ফলের জুস উৎপাদনে বিশ্ব র?্যাংকিংয়ে এখন সেরা নাম আফগানিস্তান, যা ইতিমধ্যে ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, আরব আমিরাত, কাতার এমনকি জার্মানিতে রপ্তানি শুরু হয়েছে। বর্তমানে এই ডালিম এবং ডালিমের জুস বিক্রির মুনাফায় ইসলামি ইমারত সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে।

আফগানিস্তান একসময় বিশ্বে আফিম উৎপাদনে শীর্ষ অবস্থানে ছিল। দেশটির বর্তমান তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আফিম উৎপাদনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে আফিমের ফলন প্রায় ৯৫ শতাংশ কমে গেছে বলে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ-সংক্রান্ত দপ্তর এক প্রতিবেদনে বলছে, ২০২৩ সালে সারা দেশে আফিম চাষ ২ দশমিক ৩৩ লাখ হেক্টর থেকে কমে মাত্র ১০ হাজার ৮০০ হেক্টরেরও কম হয়েছে। আফিমের উৎপাদন আগের বছরের থেকে ৯৫ শতাংশ কমে ৩৩৩ টনে দাঁড়িয়েছে। মূলত তালেবানের নীতিগত পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে দেশটির অর্থনীতিতে। যদিও দেশটির বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের মানবিক সহায়তার প্রয়োজন। তবে বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে আফগানিস্তানকে টেক্কা দিয়ে মিয়ানমার বিশ্বের বৃহত্তম আফিম উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জাতিসংঘের উপরোক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর মিয়ানমারে আফিমের উৎপাদন ৩৬ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৮০ টনে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই উৎপাদন আফগানিস্তানের আফিমের পরিমাণের চেয়ে অনেকটাই বেশি। মিয়ানমার বর্তমানে গৃহযুদ্ধে পর্যদুস্ত এবং সেখানে গৃহযুদ্ধের আবহে ব্যাপক আফিম চাষ আয়ের একটা লাভজনক উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আফিম হচ্ছে হিরোইন উৎপাদনের একটি উপকরণ এবং এটি থেকে হিরোইন ছাড়াও মরফিন পাওয়া যায়, যা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

আফগান ডালিমের এই উত্থানের গল্প জানতে আমাদের যেতে হবে কাবুল থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরের কান্দাহার রাজ্যে। যেটি ইসলামি ইমারতের বিগত শাসন আমলের রাজধানী ছিল। দৃষ্টিসীমার শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার হেক্টর এলাকা জুড়ে শুধু ডালিমের বাগান। গাছে ঝুলছে পাকা টসটসে বিশাল বিশাল ডালিম। পশ্চিমাদের মতে, আফগানিস্তান মানেই সন্ত্রাসের জনপদ কিন্তু দেশটিতে তেলের খনি ইত্যাদির পাশাপাশি এত দামি দামি ফল যে উৎপন্ন হয়, সেই কাহিনি বিশ্ববাসী থেকে আড়াল করে রাখা হয়েছিল। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডালিম আর কোথাও নয় আফগানিস্তানে উৎপন্ন হয়। ইতিমধ্যে ‘পামির গোলা’ ও ‘সাফা গোলা’সহ কয়েকটি আফগান কোম্পানির হাত ধরে ডালিমসহ বিভিন্ন ফলের জুস উন্নত বিশ্বে রপ্তানি হচ্ছে। বিশেষত আফগানিস্তানের পামির গোলা সবচেয়ে বড় মার্কেটে পরিণত হয়েছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যারা এত বছর আফগানিস্তানে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে আফগানিস্তান ডালিম বা আনার উৎপাদন ও রপ্তানি শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। দেশটিতে প্রচুর পরিমাণ ডালিম চাষ হয়। তবে এত দিন সাধারণ ফল হিসেবে ডালিম রপ্তানি হলেও এখন সেটি পানীয় আকারে রপ্তানি হচ্ছে। পামির কোলার শাফা নামের পানীয়টি বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছে। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রয়যোগ্য কোকাকোলার বিকল্প এবং স্বাস্থ্যকর পানীয় হিসেবে ভাবা হচ্ছে। গত বছরের জুলাই মাসে এক প্রতিবেদনে আফগানিস্তানের সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করে, প্রথমবারের মতো আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডালিমের তৈরি পানীয় আমদানি করছে। সেই সময় আফগানিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ডালিমের পানীয়ের একটি চালান আফগানিস্তান থেকে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে।

মূলত হেরাতের একটি কোম্পানি ডালিমের কোমলপানীয় উৎপাদন করেছে। মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলছেন, এটি দেশীয় পণ্যের রপ্তানি আফগান অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। তিনি জানান, ‘সম্প্রতি, পামির কোলা কোম্পানির ৪৫ টন ডালিমের পানীয় বহনকারী দুটি কনটেইনার যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি পানীয়গুলো জার্মানি এবং কাজাখস্তানেও পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া তারা তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তানেও এটি রপ্তানি করে। আফগানরা এখন এই পণ্য বিশ্বজুড়ে রপ্তানি করার স্বপ্ন দেখছে।’ পামির কোলা কোম্পানি বলছে, এই সংস্থাটি ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেও এই পানীয় রপ্তানি করেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, অভ্যন্তরীণ পণ্য রপ্তানি সম্প্রসারণ আফগান অর্থনীতির বৃদ্ধি এবং জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে সাহায্য করতে পারে। তাদের মতে, এটি দেশের আরো বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে এবং রপ্তানি বাড়লে এবং সরকার আরো সুযোগ-সুবিধা দিলে বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।

খবরে প্রকাশ, গত বছর আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট শতাধিক দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে এক সপ্তাহব্যাপী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এদিকে কয়েকজন আফগান কৃষক চীনে একটি বড় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ডালিম পাঠায়। ওই প্রদর্শনীতে আফগানিস্তানের ডালিম ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এতে উল্লসিত আফগান কৃষকরা। তাদের মধ্যে একজন কৃষক সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এ বছর থেকে আমি ১০ একর জমির ডালিম সংগ্রহ করেছি। চীনে ডালিম পাঠানো খুবই ভালো। কারণ আমাদের ডালিম চীনে রপ্তানি করলে শুধু (আফগান) কৃষকই নয়, সমগ্র দেশ এবং জনগণ উপকৃত হবে।’ ওই কৃষক দক্ষিণ কান্দাহার প্রদেশের আরগান্দাদ উপত্যকায় বাস করেন। এটি আফগানিস্তানের একটি প্রধান ডালিম উৎপাদনকারী এলাকা। আফগানদের জন্য শরৎকাল হলো ডালিমের ঋতু। কান্দাহার, কাবুল, বা উত্তরের পাহাড়ের কাউন্টি যাই হোক না কেন, রাস্তায় সব জায়গায় তাজা ডালিম এবং ফলের রস বিক্রি করতে দেখা যায়। চীনে আফগানিস্তানের ডালিম পৌঁছানো এবং ডালিম রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত একজন কৃষক বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে প্রদর্শনীতে ২০০ কেজি ডালিম পাঠিয়েছিলাম। সেগুলো প্রথমে কান্দাহার থেকে স্থলপথে কাবুলে পৌঁছেছিল। সেখান থেকে বিমানে দুবাই এবং পরে চীনের সাংহাইয়ে পৌঁছেছিল। এর আগে তিনি ২০২০ সালে চীনের প্রদর্শনীতে আফগানিস্তানের হাতে বোনা কার্পেট প্রদর্শন করেছিলেন। সে সময় তিনি চীন জুড়ে দুই হাজারের বেশি কার্পেটের অর্ডার পেয়েছিলেন। যেটির মাধ্যমে প্রায় দুই হাজার আফগান পরিবার সারা বছরের আয় করেছেন। তিনি মনে করেন, আফগানিস্তানের ডালিমও বিশ্বজুড়ে শিগগিরই পৌঁছে যাবে এবং দেশটির রপ্তানিযোগ্য প্রধান পণ্য হয়ে উঠবে। আফগান ফল বিক্রেতাদের মতে, ডালিম হলো দেশের কৃষকদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক ফসল। এর অর্থনৈতিক মূল্য আঙুর, আপেল এবং পার্বত্য দেশে উৎপাদিত অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী ফলের তুলনায় বেশি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে গাজা ইসরায়েল সংঘাতের পর যেভাবে পেপসি-কোকাকোলার বয়কটের জোয়ার চলছে, এর মধ্যে আফগান জুস ও কোমলপানীয় ফাঁকা মার্কেট দখল করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমনকি সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের কোমলপানীয় আমদানি পরিকল্পনা দেখা গেছে। বয়কটের এই জোয়ার মঞ্চে যদি আফগান কোম্পানিগুলো এই ফাঁকা মার্কেট ধরে ফেলতে পারে, তবে বিরাট বাজিমাত হয়ে যাবে।

বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, তালেবান ক্ষমতার আসার পর দেশটিতে ডালিমের উৎপাদন তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইমারত সরকার যখন আফিন চাষ নিষিদ্ধ করল, তখন অনেকেই উপহাস করে বলেছিল, মোল্লাদের ইনকামের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ইমারত সরকারের সুশাসনে সেখানে একের পর এক খনি আবিষ্কার হচ্ছে, অন্যদিকে আফিমের বদলে ডালিমণ্ডআঙুরসহ মূল্যবান ফলগুলোর উৎপাদন ও সম্ভাবনা বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close