তাহমিনা আক্তার

  ১০ জানুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

মহানায়কের দেশে ফেরা

লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি রাতে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে ১ ঘণ্টাকাল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাজ্য কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয়টি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় তার জীবন রক্ষার প্রচেষ্টার জন্য বঙ্গবন্ধু অ্যাডওয়ার্ড হিথকে ধন্যবাদ জানান।

৯ জানুয়ারি টেলিফোনে ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আধাঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানালেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং অনুরোধ করলেন, ঢাকার পথে যেন তিনি দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে ভারতীয় ভিআইপি বিমানের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু হিথের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে তিনি জানালেন, হিথ ব্রিটিশ এয়ারফোর্স জেটে করে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। তাই ভারতীয় বিমান বহরের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। ব্রিটিশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলেও তাদের বিমানযোগে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পাঠানোর বন্দোবস্ত করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এটাই ছিল এক ধরনের স্বীকৃতি। ইন্দিরা-হিথ আলোচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মূলত তারা উভয়ই চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সুস্থ শরীরে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি গড়ে তুলুন।

লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় ১০ জানুয়ারি তিনি দিল্লিতে এক সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলিত হন এবং একটি জনসভায় ভাষণ দেন। ১০ জানুয়ারি দুপুর ১.৪৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের কমেট জেট বিমানটি ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দর অবতরণ করে।

১১ জানুয়ারি প্রকাশিত দিল্লির ‘Express’ পত্রিকার বিবরণ অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বিমানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে কয়েক মিনিট অবস্থান করেন। এবার এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। প্রায় কালো ধূসর ওভারকোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু বিমানের সিঁড়ি বেয়ে নামলেন।... প্রেসিডেন্ট শ্রী ভরাহগিরি ভেঙ্কট গিরি যখন বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন।

তখন ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানানো হচ্ছিল। শুভেচ্ছাবিনিময় পর্ব শেষ হলে বঙ্গবন্ধু তিন বাহিনীর ১৫০ সদস্যের গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন এবং পরে ভিআইপি প্যান্ডেলে যান, যেখানে তার ওপর গাঁধাফুলের পাপড়ি বর্ষণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু অভিবাদন মঞ্চে অবস্থান গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই একটি গুর্খাবাদক দল বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা... ” বাজাতে শুরু করে।’

আনুমানিক ৫ লাখ লোক রেসকোর্স ময়দানে জমায়েত হয়েছিল এবং সেখান থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত চার মাইল পথ এক লাখ লোক সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার মতো করে নির্মিত ১০০ ফুট দীর্ঘ মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে শিশুদের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন।

কান্না ছিল সেদিনের একমাত্র কণ্ঠস্বর। তিনি কাঁদছিলেন। কাঁদছিল লাখো মানুষ। যুগে যুগে অনেক কেঁদেছে বাঙালি, অনেক কান্না বুকের রক্ত হয়ে ঝরেছে। কিন্তু সেদিনের প্রক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্য অসীম মমতার আবাস যে মহামানবের বুকে, তাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে উদ্বেল বাঙালি অঝোরে কেঁদেছে ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি। আর তিনি কাঁদছিলেন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রাণাধিক প্রিয় জনতার মাঝে আসতে পেরে।

বঙ্গবন্ধু আবেগময় কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি, বিশ্বকবি তোমার সেই আক্ষেপ মিথ্যা প্রমাণিত করে সাত কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে।’

ভাষণের একপর্যায়ে বলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ। বাংলা আমার ভাষা।’

বক্তৃতার শেষের দিকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায় তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম তার প্রাণ দেবে। ...একজন বাঙালিরও প্রাণ থাকতে স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না।’

বিখ্যাত ব্রিটিশ পত্রিকা ‘The Guardian’- এ ১০ জানুয়ারি ‘Recognize Bangladesh Now’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়- ‘Once Sheikh Mujibur Rahman steps

out of Dacca Airport, the new republic becomes a solid fact.’

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ‘Newsweek’ ম্যাগাজিনের ভাষায় ‘Poet of Politics’ মুজিবের অমর কাব্য। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধুর জীবনিকার ওবায়েদ-উল হকের (১৯১১-২০০৭) ভাষায়, ‘যদি বাংলাদেশ একটি মানুষের দৈহিক আকৃতি পায়, তা হবে দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো।’

সর্বোপরি বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যতবার কারা ভোগ করেছিলেন তা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন, কারাবন্দি হিসেবে তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুর ও মিয়ানওয়ালির নির্জন সেলে। সেখানে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করায় প্রহসনমূলক বিচারের সম্মুখীন হন। জেনারেল ইয়াহিয়ার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে দিতে পারেননি। অবশেষে শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মহানায়ক ফিরে এলেন তার প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলায়।

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close