রায়হান আহমেদ তপাদার
দৃষ্টিপাত
স্বনির্ভর বাস্তবমুখী বাজেট সবার কাম্য
বিশ্বব্যাপী যে উচ্চমূল্যস্ফীতি ও নিম্ন প্রবৃদ্ধি মিলে যে মন্দা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, তার উত্তাপ আমাদের অর্থনীতিতেও অনুভূত হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য আমাদের নিজস্ব পণ্য ও সেবার জোগান বাড়াতেই হবে। বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসাবে ঘাটতি মোকাবিলার জন্য আরো উদ্ভাবনীমূলক নীতি বাস্তবায়নের কথা ভাবতে হবে। নিশ্চয়ই এ বছরও প্রবৃদ্ধি চাই। তবে তার চেয়েও বেশি চাই সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা। একই সঙ্গে আয় বুঝে ব্যয় করার কৌশলই হতে হবে আসন্ন অর্থবছরের মূলনীতি। এ ছাড়া যারা মাথাপিছু আয় বাড়ার সুফল তুলনামূলক বেশি পাচ্ছেন সেই অতিধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর বেশি করে আদায় করে তা সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
সংকট মোকাবিলার জন্য অর্থবছরের মাঝপথেও নীতিকৌশল বদলাতে হতে পারে। সে রকম পরিবর্তনের জন্য সব অংশীজনকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে যাদের আয় এরই মধ্যে কমেছে, অনানুষ্ঠানিক খাতের যারা কাজ হারিয়েছেন তাদের পাশে সরকার খাদ্য সহায়তাসহ বাড়তি সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে হাজির থাকবে- এ কথাটি আরো স্পষ্ট করে বলা দরকার। নির্বাচনের আগে এটাই শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট এমন একসময় প্রণীত হচ্ছে, যখন নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও সংকটে বৈশ্বিক অর্থনীতি টালমাটাল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মন্দার হাতছানি, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, চীনের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ধীরগতি, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণে খাদ্যশস্য, সার ও জ্বালানি উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খল বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং অবরোধ ও পাল্টা অবরোধে সার্বিকভাবে বিশ্বের সব দেশই সমস্যাসংকুল।
তা ছাড়া এ বছরের ডিসেম্বরে বা আগামী বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে দেশের জাতীয় নির্বাচন। একদিকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা, অন্যদিকে নির্বাচন-পূর্ব বাজেট হিসেবে জনতুষ্টির দিকে লক্ষ রেখে এবারের বাজেট প্রণীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন ও প্রকাশ যেকোনো দেশের উন্নয়নের দিকনির্দেশক। কিন্তু জলবায়ু সংকটকে বিবেচনায় আনলে এই উন্নয়ন কেমন হবে, তা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘কান্ট্রি অ্যান্ড ক্লাইমেট ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে’ বলা হয়েছে, বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে কিছু সফলতা দেখিয়েছে। তাই এ খাতে অবকাঠামো নির্মাণে দরকার আরো সহায়তা প্রদান, যা দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি, জ্বালানি এবং যানবাহন খাত থেকে কার্বন নির্গমন কমানোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এই কার্যকর ব্যবস্থা এমন হবে, যেন পরিবেশের ভারসাম্য অর্থাৎ মাটি, পানি ও বায়ুর বৈশিষ্ট্য নষ্ট না হয়।
জলবায়ু সংকট উত্তরণের মধ্যমেয়াদি কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ অতিরিক্ত ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন বাজেটে জলবায়ু কার্যক্রমের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া, কার্বন কর আরোপ, বহিঃসম্পদ আহরণ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ আরো জোরদার করা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর বেশি পড়বে। বিশ্বব্যাংকের এক হিসাবে দেখা যায়, প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশে গড়ে এক বিলিয়ন ডলার অপচয় হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি খাত থেকে প্রাপ্ত এক-তৃতীয়াংশ জিডিপি কমে যাবে এবং প্রায় ১৩ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে পরিযায়ী হবে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা হলো- মানবকেন্দ্রিক এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন, কার্বন নির্গমন হ্রাসের মাধ্যমে উন্নয়ন এবং প্রতিষ্ঠান এবং পরিবেশের মধ্যে পুনর্বিন্যাস ও সমন্বয়। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পার্থক্যের আলোকে অভিযোজনের ওপর গুরুত্ব আরোপ এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শক্তি, যানবাহন, শিল্প ও কৃষি খাতে কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা, বিদ্যমান আইন ও প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন করতে হবে এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকারকে আরো শক্তিশালী করতে হবে এবং স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। ব্রিটেনে ২০২৩ সালের বসন্তকালীন বাজেটে প্রবৃদ্ধির দিকনির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নিট শূন্য কার্বন নির্গমনের লক্ষ্যে বিনিয়োগ, স্থিতিস্থাপকতা, লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অর্থনৈতিক বিকাশকে পরিবেশ বান্ধবমুখী করা। এ থেকে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সরকার কর্তৃক ২০৫০ সালের মধ্যে নিট শূন্য কার্বন নির্গমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মধ্যে আর্থিক ঝুঁকি রয়েছে। নিট শূন্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক প্রভাব কী। বাজেটে বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ এবং ভর্তুকির ব্যবস্থাও রয়েছে।
উল্লেখ্য, ইউরোপে সামগ্রিকভাবে জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বাজেট থেকে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাবে না বলে অনেকে মনে করেন। এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়নে সহায়ক হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জিডিপির ওপর যে প্রভাব তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা প্রয়োজন। বাজেটে জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদন দ্বারা প্রবৃদ্ধির গণনা করলেও তা পরিবেশবান্ধব নাও হতে পারে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর জন্য বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, প্রশাসক, নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী এবং অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান- সবার সদিচ্ছা প্রয়োজন। প্রতি বছর বাজেটে যা উন্নয়ন বরাদ্দ থাকে তার সবটা খরচ করা সম্ভব হয় না। এখনো আমাদের বাজেটের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতার জন্য এবং আরো নানা কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্ব হয়। সেজন্য বাজেট বরাদ্দ সুষ্ঠুভাবে খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।
আমাদের দেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সবটাই বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে ঘটে না, বরং এর পেছনে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর অতি মুনাফাখোরি মনোবৃত্তিই দায়ী। চিনি, চাল, ভোজ্য তেলসহ বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ ও মূল্য নির্ধারণ গুটি কয়েক ব্যবসায়ী গ্রুপের তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে। এ বিষয়ে সরকারি মনিটরিং জোরদার করা দরকার। ২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাসের কারণে এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্বমন্দা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শিল্প উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকেই কর্ম হারিয়ে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়ে। সেজন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে আরো নতুন জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন হবে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গত বছরের তুলনায় বাজেট বৃদ্ধিরও চিন্তা করতে পারে। তা ছাড়া বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মহীনদের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
অন্যদিকে গেল বছরগুলোতে শিক্ষা ও কৃষি ক্ষেত্রেও বাজেটের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অথচ এই দুটি খাত দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাই নতুন বাজেটে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব পাক- এমনটাই সবার চাওয়া। বিভিন্ন পরিস্থিতি বিবেচনা সাপেক্ষে, সময়োপযোগী এবং জনবান্ধব কর্মসূচিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে উপস্থাপিত হবে আগামী বাজেট। নিত্যপণ্যের দাম নাগালের মধ্যে রাখতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়া হচ্ছে। চলতি বাজেটে খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে অপ্রয়োজনীয় আমদানি বন্ধ করা দরকার। এসব আমলে নিয়ে সুপরিকল্পিত বাজেট প্রণয়ন করতে হবে আগামীতে। ভর্তুকি ব্যয় কমিয়ে আনা এবং সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর মতো কর্মসূচি হাতে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে আগামীতে। এমনিতেই বাড়তি দ্রব্যমূল্য তার ওপর ভর্তুকি কমানোর কারণে আবার যেন বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি জনগণের কষ্টের কারণ না হয়, সেদিকটিও বিবেচনায় নিতে হবে বাজেটে। গত অর্থবছরের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করে আগামী অর্থবছর কেমন হতে যাচ্ছে, সে বিষয়টি মাথায় রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে গতিপ্রকৃতি ঠিক করতে হবে। সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক
"