তানজিব রহমান

  ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

পর্যালোচনা

পালালে আত্মরক্ষা হয় দেশ রক্ষা হয় না

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে গণতন্ত্র উদ্ধার ও সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে ঢাকাতে চার দিনের পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ঢাকা মহানগর উত্তরের উদ্যোগে গত শনিবার পদযাত্রায় অংশ নিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ করে বলেছেন পদত্যাগ করুন, না হলে পালানোর পথ পাবেন না। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরদিন রবিবার বিকালে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দানে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট বলে বেড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ পালানোর পথ পাবে না। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই আওয়ামী লীগ কখনো দেশ ছেড়ে পালায় না। বরং দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি নেতারা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।’ বিএনপির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা নাকি ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতির বিচার করবেন। যে দলের নেতানেত্রীরা দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছে, তারা কীভাবে অন্যের দুর্নীতির বিচারের কথা মুখে আনে। তারেক রহমান নাকি দেশে ফিরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এসব হুমকিকে ভয় পায় না। কারণ আওয়ামী লীগ জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করে, কোনো দুর্নীতি করে না। এরপরই পালানোর বিষয়ে রাজনীতির ময়দানে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হতে শুরু করে।

বাংলার রাজনীতিতে পালানোর সংস্কৃতি নতুন নয় বহু পুরোনো। রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের কারণে কিংবা সম্পদ লুণ্ঠনের কারণে এ অঞ্চল থেকে নিকট অতীতে যেমন অনেকে পালিয়েছে তেমনি সুদূর অতীতেও আত্মরক্ষার জন্য অঞ্চল ত্যাগ করেছেন কেউ কেউ। বাংলার ইতিহাসে সেন বংশের অন্যতম প্রভাবশালী শাসক ছিলেন লক্ষণ সেন। দিল্লি সালতানাতের তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলা আক্রমণের ফলে বাংলার রাজধানী নদীয়া হতে পালিয়ে গিয়ে তিনি আত্মরক্ষা করেছিলেন। তখন তিনি দেশের কথা ভাবেননি পরে দেখা গেল তিনি দেশ রক্ষা করতে পারেননি। দেশ চলে যায় ইখতিয়ার উদ্দিন তথা দিল্লি সালতানাতের অধীনে। অর্থাৎ পালিয়ে গেলে আত্মরক্ষা হয় কেবল দেশ রক্ষা হয় না। আদর্শের রাজনীতি বা জনকল্যাণকামী রাজনীতির কাছে জনগণই মুখ্য তবে রাজনীতি যদি আত্ম উন্নয়ন বা সম্পদ লাভের হাতিয়ার হয় এক সময় তা রাজনীতিবিদদের গলার কাটা হয়ে দাঁড়ায়। যা বাংলাদেশ এক-এগারোর সময় লক্ষ্য করেছে। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করা মামলায় জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঘোষিত আয়ের বাইরে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার মালিক হওয়া এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ মামলা দায়ের করেছিল। বাংলাদেশের কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে সিঙ্গাপুর ৮ কোটি টাকা ফেরত দেয়। গণমাধ্যমের তথ্য থেকে দেখা যায় তারেক রহমান ও তার ব্যবসায়িক বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুন সিঙ্গাপুরে সিটিএনএ ব্যাংকে ২১ কোটি টাকা পাচার করে। আমেরিকার এফবিআই এ ব্যাপারে তদন্ত করেছে। ২০১২ সালে এফবিআই ঢাকায় বিশেষ আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে গেছে। এ মামলায় হাইকোর্টে তারেক রহমানের সাত বছরের সাজা ও ২১ কোটি টাকা জরিমানা হয়। এক-এগারোর পর যারা দুর্নীতি মানিলন্ডারিং অর্থ পাচার ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদির দায় মাথায় নিয়ে মুচলেকা দিয়ে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন তারা আত্মরক্ষা করেছিলেন কেবলমাত্র প্রকৃত অর্থে দেশ রক্ষা করতে পারেননি। বাংলাদেশ রক্ষার মিশনে তারা পরাজিত।

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকার রাজনীতির রূপ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখাসহ জনসমর্থন আদায়, জনসমর্থন বৃদ্ধি, ধরে রাখা ও নতুন প্রজন্মের ভোটারদের আকৃষ্ট করতে রাজনৈতিক নানা কর্মসূচির পাশাপাশি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পরিকল্পনা তুলে ধরছেন। বিশেষ করে গোলাপবাগ সমাবেশের পর বিএনপির ‘রেইনবো নেশন’ তত্ত্ব ও আওয়ামী লীগের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ তত্ত্ব নিয়ে সবার মাঝেই আলোচনা পর্যালোচনা চলছে; থেমে নেই গণমাধ্যমের চুলচেরা বিশ্লেষণ যা আলোচনায় নতুনমাত্রা যোগ করছে। সমালোচকরা বলছেন, মাত্র ৯ মাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিকে কেন আফ্রিকান মডেল রেইনবো নেশন গ্রহণ করতে হবে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে বাঙালি জাতি তো সবসময়ই ঐক্যবদ্ধ। যা আমরা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে সবাইকে এক হয়ে অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখেছি। বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কে কোনভাবে নস্যাৎ করবার পাঁয়তারা কি না তা এখন ভেবে দেখা দরকার। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১৯৯৩ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আসিফ নওয়াজ জানজুয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ভেঙে শোক বিবৃতি পাঠিয়ে ছিলেন। জানজুয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ২০০৫ সালের ৩ মে মৃত্যুবরণ করেন। যিনি ১৬ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ চুক্তির দলিলে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন। খালেদা জিয়া সে সময়েও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন কিন্তু তিনি বিজয়ের চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী যৌথবাহিনীর এ বীর সেনানির জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো শোক বার্তা প্রেরণ করেননি। প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপির রেইনবো নেশন তত্ত্ব যদি এসবের ধারাবাহিকতা হয়? স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে এক করে দেওয়ার নতুন নীলনকশা হয়? তবে মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদ প্রাণ দিয়েছিল কী স্বাধীনতাবিরোধীদের এদেশে জায়গা করে দেওয়ার জন্য! তা নিশ্চয়ই আমাদের ভাবতে হবে।

আওয়ামী লীগ যে স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকল্প ঘোষণা করেছে তা মূলত ডিজিটাল বাংলাদেশেরই প্রাপ্তি। স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যাশা হচ্ছে একটি স্বনির্ভর জাতি হিসেবে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধ তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞান সমৃদ্ধ একটি আধুনিক জাতি। যার স্বপ্ন জাতির পিতা অনেক আগেই দেখিয়েছিলেন। যদিও আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে তারপরও করোনা অতিমারিকালে বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশের সক্ষমতা দেখাতে যে দারুণ ভূমিকা রেখেছে তা সর্বমহলে সমাদৃত হয়েছে এবং প্রশংসা কুড়িয়েছে। আগামীর অর্থনীতি যেহেতু প্রযুক্তিনির্ভর হবে তাই বাংলাদেশের মতো আয়তনে ছোট, অধিক জনসংখ্যার একটি দেশের জনগণকে জনসম্পদে রূপান্তরের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে অর্থনৈতিক অংশীজন হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালীকরণে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে প্রযুক্তিকে অন্যতম হাতিয়ার করা বুদ্ধিমানের কাজই হবে না বরং তা হবে যথার্থ। যেমনটি বাংলাদেশ ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের ডাক দিয়ে ছিল যা এখন অতীতের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের বাস্তব সুফল দিচ্ছে।

অপরদিকে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়ানো বক্তব্যের চেয়ে বরং জনগণের প্রতি নিঃস্বার্থ প্রগাঢ় ভালোবাসার উদাহরণ তো আমাদের রাজনীতিতেই বিদ্যমান। বাংলার রাজনীতিতেই আমরা হিমালয় সমান এমন রাজনীতিবিদকেও দেখেছি যিনি ইয়াহিয়ার ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বুক উঁচু করে উচ্চারণ করেছিলেন আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান একবার মরে দুইবার না; আমার যদি ফাঁসি হয় আমার লাশটা আমার বাঙালি ভাইদের কাছে পৌঁছে দিও। এমন বীরদর্পের নেতাকে বাঙালি জাতি আজন্ম মনে রাখবে যিনি বাংলার দুঃখী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, জনগণের দাবি আদায়ের জন্য জেলে থেকেছেন বছরের পর বছর। কিন্তু এখন আমরা দেখছি অর্থ পাচার বা মানিলন্ডারিংয়ের জন্য রাজনীতির বরপুত্ররা মামলার আসামি হচ্ছেন জেলের ভয়ে ফেরারি আসামি হচ্ছেন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে অর্থ ব্যয়ের খবরও গণমাধ্যমে পাওয়া যায়, বাস্তবে সম্পদ আহরণের রাজনীতি আর আদর্শের রাজনীতির মাঝে ফারাকটা স্পষ্ট। তাই বলা যায়, পালিয়ে আত্মরক্ষা করা গেলেও দেশের প্রতি তাদের কোনো দায় নেই; দেশরক্ষায় তারা বার বার পরাজিত ব্যর্থ।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close