ইমরান ইমন

  ১৮ আগস্ট, ২০২২

অভিমত

সময়ের এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি অনুপ্রেরণার নাম, একটি ইতিহাস ও আদর্শের নাম, দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের নাম, অসাম্প্রদায়িকতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের নাম, লাল-সবুজের মানচিত্রখচিত একটি স্বাধীন দেশের উদ্ভাবকের নাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক, বাঙালি স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ। তার সুমহান নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের মানচিত্রখচিত অপার সম্ভাবনাময় একটা দেশ।

বঙ্গবন্ধুর মহান নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে এ দেশের মানুষ দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে নতুন সূর্যের উদয় হয়। চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা পাই স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। স্বাধীনতাণ্ডপরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কর্মোদ্যোগের নকশা তৈরি করেন। কিন্তু তিনি সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পাননি।

সময়টা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাংলার আকাশে-বাতাসে শোকের মাতম। স্বচ্ছ আকাশে চলছিল ধূসর মেঘের লীলা খেলা। ১৫ আগস্ট আমাদের জাতীয় শোকের দিন, আমাদের বেদনার দিন, আমাদের অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন। এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে যখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের তুমুল বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁজরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অসহায় আর্তনাদ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খান।

‘মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত মেয়েদের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দিয়ো, আর ঠিকানা দিয়ে দিয়ো ধানমন্ডির ৩২ নম্বর’- এমন কথা যে বলতে পারে সে নিঃসন্দেহে মহাপুরুষ। এমন মহাপুরুষ হয়তো এ বাংলায় আর জন্ম নেবে না। বঙ্গবন্ধু একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং একটি রাষ্ট্রের স্থপতি। সমগ্র জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় উজ্জীবিত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শোষক আর শোষিতে বিভক্ত সেদিনের বিশ্ববাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন শোষিতের পক্ষে। বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হত্যা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি চিরঞ্জীব। কেননা মহামানবের কখনো মৃত্যু হয় না। সৃষ্টির মধ্য দিয়েই তারা মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকেন। বঙ্গবন্ধু এমন এক মহামানব যিনি আমাদের মধ্যে অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে জন্ম থেকে জন্মান্তরে বেঁচে থাকবেন।

পাকিস্তানি শাসন-শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্‌যানের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার যে ডাক দিয়েছিলেন তা অবিস্মরণীয়। সেদিন তার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই অমর আহ্বানেই স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিপীড়িত নিষ্পেষিত বাংলার আপামর জনসাধারণ। সেই বজ্রকণ্ঠের প্রেরণায় বাঙালি হয়ে উঠেছিল লড়াকু এক বীরের জাতি। আবার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেও বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেই জাতি শুনেছিল মহান স্বাধীনতার অমর ঘোষণা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই রাতে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তাকে বন্দি থাকতে হয় পাকিস্তানের কারাগারে। তার আহ্বানেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। বন্দিদশায় মৃত্যুর খবর মাথায় ঝুললেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করেননি অকুতোভয় এ মহান নেতা। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। বীরের বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এবং কতিপয় বিপথগামী কিছু সেনা সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। বিশ্ব ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেদিন তারা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই নয়, তার সঙ্গে বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতার আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। মুছে ফেলতে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল বাঙালির বীরত্বগাথা ইতিহাসও। ১৯৭৫-পরবর্তী নানা সময়ে বঙ্গবন্ধুকে মনোজগৎ থেকে সরিয়ে ফেলার নানা চক্রান্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু নির্বাসনের পরিকল্পনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এমন এক ব্যক্তিত্ব যাকে পাঠ্যপুস্তক, পত্রিকার পাতা বা টেলিভিশনের পর্দা থেকে সরিয়ে দিলেও বাঙালির মানসপট থেকে তাকে কখনোই সরানো যাবে না।

১৯৭৫ সালের এই নির্মম ঘটনার পর থেকে প্রতি বছর আগস্ট মাস এলেই আমরা শোকাহত হই। পুরো জাতি শোকের ছায়ায় মাতম হয়ে পড়ি, ভেঙে পড়ি বেদনায়। রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের শোককে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম শক্তিতে পরিণত করতে পারে। শোক থেকে নতুন উদ্যমে জাগরণের শপথ নিতে পারে। কারণ, তরুণ প্রজন্ম একটা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। তাদের ওপরই আগামীর দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনা এবং দেশপ্রেমের মহান আদর্শ বুকে ধারণ করে আমরা বিনির্মাণ করতে পারি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’। সেটিই এখন জাতির প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close