অরূপ তালুকদার

  ২১ জুন, ২০২২

মুক্তমত

‘মাঙ্কিপক্স’ প্রতিরোধে সতর্কতা জরুরি

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমরা বেশ ভাগ্যবান। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর উল্টোটাও ঘটে। এখন আমরা সাহস করে বলতে পারি, করোনা মহামারি তুলনামূলক আমাদের ততটা বিপদে ফেলতে পারেনি, যতটা পেরেছে উন্নত পশ্চিমা দেশের কোটি কোটি মানুষকে। আমাদের দেশে এখন করোনায় মৃত্যু নেই বললেই চলে, আক্রান্তও অতি সামান্য। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশে এখনো সেই ভয়ংকর করোনায় আক্রান্ত হয়ে কমবেশি মৃত্যু ঘটছে, আক্রান্তও হচ্ছে। যার ফলে পৃথিবীতে এখনো কোভিড-১৯ ভাইরাসে প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার। এ পর্যন্ত করোনা মহামারিতে পৃথিবীতে মৃত্যু ঘটেছে ৬৩ লাখেরও বেশি মানুষের। আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৫৪ কোটি।

তবে করোনার করাল থাবা থেকে মানবজাতি পুরোপুরি মুক্ত হতে না হতেই পৃথিবীতে আরেকটি নতুন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, যার নাম ‘মাঙ্কিপক্স’, যা এখন নতুন করে কোথাও কোথাও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, শুধু গত মাসে বিভিন্ন দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তিন শতাধিক মানুষ। ফলে পুনরায় এদিকে মনোযোগ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা চিন্তাভাবনা করে দেখছে এখনই এই প্রাদুর্ভাবকে কোভিড-১৯ ভাইরাসের মতো জরুরি পরিস্থিতির নিরিখে মূল্যায়ন করা হবে কি না।

উল্লেখ্য, ‘মাঙ্কিপক্স’ ভাইরাসকে জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করা হলে রোগটির বিস্তার ঠেকাতে অতিদ্রুত গবেষণা এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হবে। অতিসম্প্রতি গণমাধ্যমের কাছে সংস্থাটির এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আফ্রিকার বাইরে মাঙ্কিপক্স-এর প্রাদুর্ভাব বৈশ্বিক মহামারিতে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেহেতু আপাতত আতঙ্কিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই।’

জানা যায়, ১৯৫৮ সালে এক ল্যাবরেটরিতে সর্বপ্রথম বানরের দেহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা গিয়েছিল আর সে কারণেই পরবর্তীকালে ১৯৭০ সালে এই ভাইরাসজনিত রোগের নামকরণ করা হয় ‘মাঙ্কিপক্স’।

দেখা যাচ্ছে, করোনা সংক্রমণ ক্রমেই নিম্নমুখী হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞাত কারণে এই ভাইরাসটি বেশ দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশে। আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে এবং এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৫৫০ জনের মতো। যেসব দেশে এ রোগের বেশি প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, আফ্রিকা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ইসরায়েল। এরই মধ্যে কমপক্ষে ৩০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে মাঙ্কিপক্স।

উল্লেখ্য, ইউরোপীয় দেশগুলোতে ‘মাঙ্কিপক্স’ সম্পর্কে প্রথম রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল গত ৭ মে ও অন্যদিকে, আফ্রিকান দেশগুলোতে এই রোগের দেখা মিলেছিল বিগত ২০১৭ সাল থেকে। প্রাথমিক পর্যায়ে সেখানে ১ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যুর হার রিপোর্ট করা হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৩ সালে এই ভাইরাসের যে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল তাতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ছিল না। তারা আরো দেখেছেন, তুলনামূলক এই রোগ অন্যদের তুলনায় সমকামী পুরুষদের মধ্যে বেশি ছড়াচ্ছে। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র সহকারী মহাপরিচালক ড. ফল এক সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আমরা এখন পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারী পুরুষদের মধ্যেও এই রোগের সংক্রমণ দেখছি।’

এখন সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যা ধারণা করা হচ্ছে সেটা হলো যে, সংক্রমণ যতই হোক না কেন মৃত্যুর ঘটনা তেমন দেখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, এই রোগে তৈরি হওয়া জটিলতার মধ্যে রয়েছে কখনো কখনো সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট, কোনো অঙ্গে স্থায়ী ক্ষত, খারাপ ধরনের দাগ, কেরাটাইটিস, কর্নিয়াল আলসার, এনসেফ্যালাইটিস এবং যথাসময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত অন্ধত্ব ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, ‘মাঙ্কিপক্স’ একটি জেনেটিক ভাইরাস, যা নিয়ন্ত্রণে আনতে বা প্রতিরোধে গুটিবসন্তের টিকা অধিকতর, প্রায় ৮৫ শতাংশ কার্যকর। এই রোগের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ধরা হয় সাধারণত গড়ে বারো দিন, অর্থাৎ চার থেকে একুশ দিন। শুরুতে এক সপ্তাহের মধ্যেই সাধারণত মুখে ব্যথাহীন ফুসকুড়ি দেখা দেয়, তারপর শরীরের অন্যান্য স্থানে। সঙ্গে থাকে ঠাণ্ডাজনিত জ্বর, মাথাব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য, শ্বাসকষ্ট এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাশি। এই রোগ তেমন ছোঁয়াচে নয়, তাই এমন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে রোগের কারণে তৈরি হওয়া ক্ষতগুলো না শুকানো পর্যন্ত আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টাইনে রাখা প্রয়োজন।

‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র ইউরোপীয় প্রধান ড. হান্স হেনরি পি কুলুগান সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, ইউরোপ-আমেরিকার অধিবাসীরা এখন আবার যদি তুলনামূলকব অধিকসংখ্যক পার্টিতে যোগ দেন এবং গ্রীষ্মকালে যদি বেশি করে ছুটি কাটাতে যায় তাহলে এই রোগ আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে।

আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বিশেষ করে বিশ্বের পশ্চিমা ধনী দেশগুলোতে এই রোগের সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। পাশাপাশি এই ভাইরাসটি নিয়ে নানা ধরনের গবেষণার কাজও জোরদার করা হয়েছে। তবে এই সঙ্গে গবেষণালব্ধ সুফল যাতে বিশ্বের গরিব দেশগুলোও পেতে পারে তার প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণারত বিজ্ঞানীরা একটা বিষয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখছেন, মূলত এই রোগের উৎপত্তি স্থল আফ্রিকা বলা হলেও অনেক মানুষ আফ্রিকায় না গিয়েও এই রোগের শিকার হয়েছে।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘নাইজেরিয়া সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল’-এর পরিচালক ইফেদা বলেছেন, ২০১৭ সাল থেকে ‘মাঙ্কিপক্স’ সংক্রমণ শুরু হয়েছে নাইজেরিয়ায়। সেখানে এ পর্যন্ত ২৫০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। ফ্রান্সভিত্তিক বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের গবেষকরা বলেছেন, মাঙ্কিপক্স রোগকে আগে যৌনবাহিত রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) বলেছে, ‘এই রোগের বিস্তার এবং সংক্রমণ বেশির ভাগই হয়েছে যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে।’

লেখক : শব্দসৈনিক ও কথাসাহিত্যিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close