রেজাউল করিম খোকন

  ২৬ মে, ২০২২

বিশ্লেষণ

অর্থনীতিকে ভিত্তি ধরে নগরায়ণ হতে হবে

ঢাকা শহর এখন একটি দর্শনহীন, ভিশনহীন ও সমন্বয়হীন দুষিত নগরে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট নগর দর্শন, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এ শহর নিয়ে আমাদের সামনে স্পষ্ট কোনো ভিশনও নেই। গ্রামীণ এলাকা থেকে নগরমুখী অভিবাসনের হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রামের জীবনযাপন আরো জটিলতার আবর্তে পড়ে যাবে সন্দেহ নেই। গ্রাম এবং ছোট্ট মফস্বল শহরগুলো থেকে বড় শহরে লোকজনের অভিবাসনের কারণগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক কারণটাই মুখ্য। শহরমুখী গ্রামীন জনস্রোত বেড়ে যাওয়ায় শহর এলাকায় জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। শহর এবং গ্রাম এলাকায় আয়ের বৈষম্যই শহরমুখী জনস্রোত বৃদ্ধির একমাত্র কারণ নয়। আজকাল শহরাঞ্চলে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজের কর্মক্ষমতা বাড়ানো এবং উপার্জন স্তর উন্নত করার নানা সুযোগ থাকায় গ্রাম থেকে অনেক নারী-পুরুষ শহরে পা রাখছেন। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে গ্রাম থেকে আসা অনেক নারী-পুরুষ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে মানবসম্পদ উন্নয়নের চমৎকার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বটে। তবে এর ফলে শহরগুলোতে বাড়তি জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে এটা না মেনে উপায় নেই।

ছোট শহরগুলোতেও এখন গ্রামের মানুষের অভিবাসন হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী ছোট শহরগুলোর জীবনমানের তেমন উন্নয়ন ঘটেনি, অনেক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। উন্নত স্বাস্থ্য সুবিধা এবং মানসম্মত শিক্ষার সুযোগসমৃদ্ধ উপযুক্ত স্কুল-কলেজের সংখ্যা পর্যাপ্ত না হওয়ায় ছোট শহরগুলো আকর্ষণ হারাচ্ছে অনেকের। যে কারণে সেখান থেকে রাজধানী ঢাকা এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শহরে বাড়তি জনসংখ্যার চাপ দিন দিন বাড়ছে। মূলত আশপাশের সংলগ্ন ছোট জেলা-উপজেলা শহরগুলো থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে অভিবাসন ঘটছে। দারিদ্র্য, বছর জুড়ে কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নানা বিপর্যয়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন প্রভৃতির শিকার গ্রামের অসহায় বিপর্যস্ত মানুষগুলো অনেকটা নিরুপায় হয়ে শহরমুখী হচ্ছে।

গত কয়েক দশকে ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরে গ্রাম ছেড়ে আসা নারী-পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানার প্রসার। এর ফলে খুব দ্রুত অভাবনীয় হারে কর্মসংস্থানের চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গার্মেন্টশিল্প ছাড়াও বিভিন্ন রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলোতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য শ্রম চাহিদার বিকাশ ঘটেছে। সেই চাহিদা পূরণ করতে গ্রাম থেকে অনেক নারী-পুরুষ শহরে আসছেন। একসময় অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চল থেকে অর্থনৈতিক সামাজিকভাবে উন্নত শহর এলাকায় যেমন- ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রামে গ্রাম ছেড়ে শহরে অভিবাসনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল দারিদ্র্য। প্রচণ্ড অভাব ছিল গ্রামগুলোতে। কৃষকরা তাদের ন্যায্য মূল্য পেতেন না উৎপাদিত কৃষিপণ্যের। আবাদি জমি অনুর্বর থাকত। সেখানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদের তেমন উদ্যোগ ছিল না। যে কারণে গ্রামে অভাব, মঙ্গা, দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকত। তখন কেউ কেউ অভাবের যন্ত্রণা সইতে না পেরে সচ্ছলতা সমৃদ্ধির আশায় শহরে পা রাখতেন। তখন মানুষ অন্নের অভাবে শহরমুখী হতো কোনোভাবে কাজ করে পেট চালানোর জন্য।

শহরমুখী গ্রামীণ জনস্রোতকে অনুৎসাহিত করতে হলে গ্রামেই তাদের কর্মসংস্থানের নানা আকর্ষণীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বছর জুড়ে যেন কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়, কৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ডের বাইরে ছোট-বড় শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ জোরালো করতে হবে। গার্মেন্টশিল্প কারখানাগুলো শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম নগরী এবং এর শহরতলিতে সীমাবদ্ধ না রেখে ধীরে ধীরে গ্রাম এলাকাতেও ছড়িয়ে দিতে হবে। গার্মেন্ট শিল্প-কারখানা স্থাপনের উপযোগী অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে গ্রামগুলোতে। গ্রামীণ এলাকায় ছোট এবং মাঝারি আয়তনের গার্মেন্ট ও অন্য শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলে অপেক্ষাকৃত স্বল্প মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া সম্ভব হবে। এতে শিল্প উৎপাদনব্যয় কমবে অনেকাংশে। গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলে গ্রামের লোকজনকে আর কাজের জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাতে হবে না। অর্থনৈতিক ভিত্তি ছাড়া কোনো শহরই গড়ে ওঠেনি। তাই অর্থনীতিকে ভিত্তি ধরেই আগামীর নগরায়ণ করতে হবে।

নগরায়ণের জন্য প্রয়োজন সঠিক এবং যথাযথ পরিকল্পনা। শুধু রাজধানী ঢাকা শহর নয়, সারা দেশের নগরায়ণ নিয়ে গুরুত্ব সহকারে চিন্তাভাবনা করতে হবে। অর্থনীতিকে ভিত্তি ধরে এই নগরায়ণ হতে হবে, যাতে সেখানেই প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। শহরগুলো যাতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে স্বনির্ভর হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে ওই শহরের সমস্যা শহরের মধ্যেই সমাধান করা সম্ভব হয়। দেশ স্বাধীনত হওয়ার পরপর দেশের নগরায়ণের মাত্রা ছিল ৭-৮ শতাংশ, যা বর্তমানে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এ হিসাবে দেশের জনসংখ্যার প্রায় ছয় কোটি মানুষ নগরে বাস করে। তবে নগরায়ণের মাত্রার ক্ষেত্রে বেশ তারতম্য রয়েছে। অর্থাৎ সব জেলায় নগরায়ণের মাত্রা এক রকম নয়। দেশের যেসব এলাকায় অর্থনৈতিক বিকাশ লাভ ঘটেছে, যেসব এলাকা অর্থনৈতিকভাবে উন্নত সেই এলাকায় নগরায়ণের হারও বেশি।

আসলে ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রবণতা নানাভাবে সমস্যা ও সংকট সৃষ্টি করছে। এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের ফোকাস তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া বিভাগ, জেলা ও উপজেলাগুলোতে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণে ও স্বনির্ভর শহর গড়ার প্রতি জোর দিতে হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নতুন শহরগুলোকে অবশ্যই স্বনির্ভর হতে হবে। যাতে করে ওই শহরের সমস্যা সেখানেই সমাধান করা যায়। ঢাকার উপকণ্ঠে পূর্বাচলে ১০ লাখ মানুষের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হলেও ভবিষ্যতে সেখানে ২০ লাখ মানুষের বসবাস হবে ধারণা করা যায়। সেখানে বসবাসরত মানুষের ৯০ শতাংশ যদি কর্মসংস্থানের জন্য মূল ঢাকা শহরে প্রতিদিন ঢুকতে হয় তাহলে ৩০০ ফুট রাস্তা ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, কিছুতেই বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হবে না।

নগরায়ণের ক্ষেত্রে আমাদের এখানে অনেক ভালো পরিকল্পনা হয়েছে কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু ঢাকা-চট্টগ্রামকেন্দ্রিক উন্নয়ন নিয়ে ভাবলে চলবে না, সারা বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে হবে, তা না হলে আগামীতে বড় ধরনের সংকট প্রকট হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে বলা যায়। দেশে প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। এটি যদি রক্ষা করা না যায় উপজেলাগুলোর অবস্থাও ঢাকা শহরের মতোই হবে। দেশে উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্যও বাড়ছে ব্যাপক হারে। নগর দরিদ্রের জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এ কাজটি ঠিকঠাকমতো করতে না পারলে নগর দরিদ্রদের অবস্থার পরিবর্তন করা যাে বনা। নগরমুখী অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নগর দারিদ্র্য বাড়তেই থাকবে। ঢাকা শহরের পা রাখা জনগোষ্ঠীর ২১ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জীবন ও জীবিকার তাগিদে আসা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল শহরের বস্তিগুলো আয়তনের মাত্র ৪ শতাংশ এলাকায় অবিস্থত হলেও শহরের জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশেরও বেশি এসব বস্তিতে বসবাস করে। কিছু বস্তিতে প্রতি বর্গমাইলে এক লাখের বেশি লোক বসবাস করে।

জলবায়ু পরিবর্তন শহরের পরিবেশকে প্রভাবিত করছে। নগরগুলোর তাপমাত্রা বাড়ছে দিনে দিনে। ঢাকা নগরীর ল্যান্ডফিল থেকে মাত্রাতিরিক্ত মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন শহর ও উপশহরের মধ্যে জীবনযাত্রার মানে পার্থক্য রয়ে যাচ্ছে, সবাই সমানভাবে সুযোগ পাচ্ছে না। সরকারি আবাসন প্রকল্প করা হয়েছে ঢাকা চট্টগ্রাম শহরে। কিন্তু সেখানে থেকে নগরের দরিদ্ররা কোনোভাবেই লাভবান হচ্ছে না। ঢাকার পূর্বাচল ও ঝিলমিল কিংবা চট্টগ্রামের অন্যান্য আবাসিক প্রকল্পগুলোতে দরিদ্র, নিম্নবিত্তদের জন্য জমি রাখা হয়নি। ভবিষ্যতে টেকসই, পরিবেশবান্ধব, বয়স্ক নাগরিকবান্ধব নগর গড়তে যে ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো এবং ব্যবস্থা থাকা দরকার তা এখনো গড়ে ওঠেনি। এজন্য অনতিবিলম্বে নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয় নামে একটি আলাদা মন্ত্রণালয় চালু করা প্রয়োজন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close