মাছুম বিল্লাহ

  ১৬ জানুয়ারি, ২০২২

বিশ্লেষণ

শিক্ষা জাতীয়করণের মধ্যেই সার্বিক উন্নয়ন নিহিত

বাংলাদেশের শিক্ষা জাতীয়করণ নিয়ে বহু আগে থেকেই আলোচনা, সমালোচনা, হিসাব, উত্তেজনা, আন্দোলন, প্রায় ঘোষণা দেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো চলে আসছে। বেসরকারি শিক্ষকরা সেই সরকারি তিরিশ টাকা অনুদান দিয়ে শুরু করে আজ মূল বেতনের এক শ ভাগ সরকারি কোষাগার থেকে পাচ্ছেন। এটি সহজে হয়নি বা কোনো সরকার ইচ্ছে করেই এটি তাদের দেয়নি। এটি শিক্ষকদের বহুদিনের আন্দোলনের ফসল এবং এ পর্যন্ত আসতে তাদের বহু কাঠখড় পোরাতে হয়েছে ও বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমরা বলি ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’, ‘শিক্ষকরা প্রাইভেট কেন পড়াবেন’, ‘শিক্ষকতা তো মহান পেশা’ ইত্যাদি কিন্তু আমরা চিন্তা করি না শিক্ষকদেরও তো সংসার আছে, মৌলিক চাহিদা আছে, সেগুলো পূরণ করতে অর্থের প্রয়োজন হয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের কথা এলেই আমরা অর্থের কথা বলি। কিন্তু একটি বিষয় আমরা খেয়াল করি না না যে, আমরা বহু জাতীয় প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ নয়, কোটি কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছি আর সেই লোকসানের টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জনগণের ট্যাক্সের মাধ্যমে মেটাচ্ছি। অথচ শিক্ষা যে একটি অতীব জরুরি বিষয় তা মুখে বলেই খালাস। বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা জাতীয়করণ করা বহু আগেই উচিত ছিল, শিক্ষা ক্ষেত্রে যে বৈষম্য তা বেশিদিন জিইয়ে রাখা ঠিক নয়।

এরশাদ সরকার দেশে প্রথম উপজেলা পদ্ধতি চালু করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। শুনেছিলাম তার আমলেই সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হবে। যিনি এত বড় একটি কাজ করেছেন তার দ্বারা সম্ভবও হবে এটি, কারণ এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। যেমন প্রাইমারিকে জাতীয়করণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজবর রহমান, নিশ্চয়ই একটি সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ, যা সবার দ্বারা সম্ভব হয় না। তিনি যখন প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন, তখন আমাদের জিডিপির আকার ছিল প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার, এখন তা ৪০০ বিলিয়নের ওপর। তাহলে কেন আমরা শিক্ষায় প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করব না!

শিক্ষা জাতীয়করণ করা না হলে যে কোয়ালিটি শিক্ষার কথা আমরা অহরহ বলছি তা করা সম্ভব হবে না, কারণ বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ কীভাবে হয় আমরা এ দেশের মানুষ তা জানি। যখন একজন লোক জানে যে এলাকার প্রভাবশালী কাউকে টাকা দিলেই চাকরি হয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা জানা না জানার বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তখন পড়াশোনা জানা মানুষ কেন শিক্ষকতায় আসবেন? কাজেই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ বহুকিছুর প্রভাব থাকা সত্ত্বেও অনেকটাই মানসম্মতভাবে হয়। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঘটে তার পুরো উল্টোটা। এটি চলতে দেওয়া যায় না। এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে শিক্ষক নিয়োগ। শিক্ষা-সংক্রান্ত কার্যাবলির সঙ্গে যুক্ত নন, তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ব ফলাতে আসেন ফলে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে ঘটে মারাত্মক বিঘœ। তবু কিছুটা হলেও আশার কথা যে, বর্তমানে এনটিআরসি পরীক্ষার মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে। এতে মান আগের চেয়ে নিশ্চয়ই অনেকটা ভালো হচ্ছে যদিও এখানে অনেক ধরনের সমস্যা আছে। প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতি এখনো বিদ্যমান।

একটি স্বাধীন দেশে এটি কেমন নিয়ম যে, বহু বছর ধরে মাত্র ৩১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল সরকারি। বর্তমান সরকার যেসব উপজেলায় সরকারি বিদ্যালয় ছিল না সেগুলোকে সরকারি ঘোষণা করায় বর্তমানে ৬৮০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। অর্থাৎ এগুলোর পুরো দায়-দায়িত্ব সরকারের, বাকি প্রায় বিশ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেসরকারির। মাধ্যমিক পর্যায়ের আরো ৯ হাজারের মতো মাদ্রাসাও রয়েছে। এত বৈষম্য নিয়ে সামনে আগানো যায় না। দেশের শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের। অথচ দেখা যায় সরকার এমন কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি করে, যাতে সরকারের কোষাগার থেকে অতিরিক্ত কোনো অর্থ খরচ করতে না হয়। আবার উল্টোটিও দেখা যায়, কোনো প্রভাবশালী নেতা তার এলাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল বা কলেজ) তার অবস্থা যতই খারাপ থাকুক না কেন জাতীয়করণ করে ফেলেছেন। ফলে আরেক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হচ্ছে অসমতা ও নিয়মনীতিবহির্ভূত কাজ। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় সরকারি কোষাগরে জমা নিলে প্রতি বছর সরকারের আয় হবে ২৬ হাজার কোটি টাকা। তাই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ করা হলে সরকারের অতিরিক্ত কোনো অর্থ খরচ করতে হবে না, তার পরও বিষয়টি কেন হচ্ছে না সেটি একটি বড় প্রশ্ন।

শোনা যায়, বর্তমান সরকার ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করার পরিকল্পনা করছিল অর্থাৎ প্রথম উপজেলার প্রতিষ্ঠান, পরে উপজেলার বাইরে। এটি আর এক ধরনের বৈষম্য, কারণ উপজেলা সদরে বা জেলা সদরে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকে সেগুলোর অবস্থা এমনিতেই একটু ভালো থাকে। সেখানে অর্থের সমস্যা থাকে কম, শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় মোটামুটি ভালো দেখে। সেগুলো আগে জাতীয়করণ করার অর্থ হচ্ছে- ‘তেলে মাথায় তেল দেওয়া’। সরকার এ দেশের জনগণের জন্য। গ্রামীণ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অবহেলার শিকার। এগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষক নেই, মানসম্মত শিক্ষকরা সেখানে যেতে চান না। ফলে গ্রামের লাখ লাখ শিক্ষার্থী উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতীয়করণ করা হলে অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষার অধিকার ও মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তাই জাতীয়করণ করা যদি একসঙ্গে সবগুলো সম্ভব হয়, সেটিই সবচেয়ে ভালো প্রস্তাব আর তা না হলে গ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সর্বাগ্রে জাতীয়করণ করা দরকার। উপজেলা ও জেলা সদরের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরে করা যেতে পারে।

অবসরে যাওয়া শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি দেশের বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাগুলো জাতীয়করণ করা হলে সরকারের অতিরিক্ত কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে তা তার কাছে জানতে চান। সচিব বলেন, ‘দেশের ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে সরকারের অতিরিক্ত এক হাজার কোটি টাকা খরচ হবে।’ বিষয়টি একটি অনলাইন দৈনিকে প্রচারের পর দেশের শিক্ষা জাতীয়করণ করার বিষয়টি আবার আলোচনায় চলে এসেছিল। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও শিক্ষা জাতীয়করণের বিষয় একটু পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই আশি ও নব্বইয়ের দশকে আন্দোলনের সময় প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের চেয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের স্কেল অনুযায়ী শতভাগ বেতন প্রদান এবং অন্যান্য আর্থিক সুযোগণ্ডসুবিধা বাড়ানোর বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব পায়।

এ যাবৎ যত সুবিধা শিক্ষকরা ধাপে ধাপে অর্জন করেছেন, সে সুবিধাগুলো পেতে শিক্ষকদের বহু আন্দোলন করতে হয়েছে, বহু ভয়ভীতির মধ্যে পড়তে হয়েছে। অথচ এগুলো শিক্ষকদের পাওয়ার কথা ছিল স্বাভাবিকভাবেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০৯-১৪) সরকার গঠন করলে এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে এবং জাতীয়করণ করা হলে সরকারের অতিরিক্ত ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। তবে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠনের সমবায়ে গঠিত অন্যতম বড় মোর্চা ‘শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট’ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘চাকরি জাতীয়করণে বর্তমানে বরাদ্দের তুলনায় বাড়তি কোনো অর্থেরই প্রয়োজন হবে না। বর্তমানে সরকার শিক্ষকদের যে টাকা দেন তার সঙ্গে প্রায় দুই হাজার পাঁচ শ কোটি টাকা হলেই শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ করা সম্ভব। শিক্ষা জাতীয়করণ করা হলে সরকারের অতিরিক্ত অর্থ যদি ব্যয়ও হয় সেটা তো এক ধরনের বিনিয়োগ। শিক্ষায় যে জাতি বেশি বিনিয়োগ করবে, সে জাতি ততই এগিয়ে যাবে।

লেখক : শিক্ষাবিশেষজ্ঞ ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close