রেজাউল করিম খোকন

  ২৮ অক্টোবর, ২০২১

পর্যবেক্ষণ

উন্নয়নের জন্য দরকার উদ্ভাবনী শক্তি

করোনাকালীন সাবধানতা অবলম্বন করতে মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে অধিকহারে আকৃষ্ট হয়েছে। করোনার সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক গ্রাহকের সুবিধার জন্য চালু করেছে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের নানা সুবিধা। বিমাযুক্ত আমানত পণ্য চালু, সহজে অনলাইনে টাকা স্থানান্তর, ঘরে বসে সহজে দ্রুত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, অনলাইনে কেনাকাটাসহ বিশেষ কিছু নতুন পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকে। এভাবে বিভিন্ন ব্যাংক করোনাকালীন গ্রাহকদের ব্যাংকে না এসে কীভাবে সেবা দেওয়া যায়, তা উদ্ভাবনের নানা প্রক্রিয়া চালু রেখেছে। করোনাকালীন সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো শিখেছে কীভাবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে প্রযুক্তির মাধ্যমে ভার্চুয়াল মিটিং, ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স ইত্যাদি সম্পন্ন করা যায়। করোনাকালীন ব্যাংকগুলো তাদের বোর্ড মিটিংসহ বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) সম্পন্ন করেছে। ভার্চুয়ালি বোর্ড মিটিং, ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স ইত্যাদি সম্পন্ন করার কারণে ব্যাংকগুলোর ব্যয় তুলনামূলক কমে গেছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট বদলে যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং প্রেক্ষাপটে মানুষের কর্মকা-ের ধরনও পাল্টাতে হয়। পুরোনো কলাকৌশল নতুন সময়ের প্রেক্ষাপটে অচল কিংবা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ এখন সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে আমাদের মাথাপিছু আয় ২২২৭ ডলারে উন্নীত হয়েছে। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উঠে গেছে বাংলাদেশের নাম। দ্রুত আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চাইছি। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ছিল একসময়ে এ অঞ্চলে। কিন্তু সেই কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবা খাতমুখী হয়েছে আমাদের অর্থনীতি।

বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে কৃষি খাতে। বাংলাদেশ মাছ, সবজি, ফল, মুরগি, ডিম উৎপাদনে বিশ্ব পর্যায়ে পণ্য হচ্ছে। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বোপরি উন্নয়নের সব সেক্টরে টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিত করতে অব্যর্থ কৌশল উদ্ভাবনে সবাই সচেষ্ট এখন। টেকসই উন্নয়নের জন্য দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থার সফলতা তার কর্মী বাহিনীর দক্ষতা, জ্ঞান ও উৎপাদনশীলতার ওপর নির্ভর করে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার, সৃজনশীলতার প্রয়োগ, উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ জরুরি। এখন সর্বত্র উন্নয়নের জন্য ইনোভেশন অর্থাৎ উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। সবাই ‘ইনোভেশন’ নিয়ে কথা বলছেন। ইনোভেশন বলতে কী বোঝায়? ‘ইনোভেশন’ বা উদ্ভাবন হচ্ছে প্রচলিত কর্ম বা সেবার প্রক্রিয়াকে আরো উন্নত করা, যা সবার জন্য নতুন সুবিধা বা উপকার তৈরি করে। নাগরিক সেবায় উদ্ভাবন বলতে সেবা প্রদান প্রক্রিয়ায় এমন কোনো পরিবর্তনের সূচনা করা, যার ফলে সংশ্লিষ্ট সেবাগ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের আগের তুলনায় সময় বাঁচে, ব্যয় সাশ্রয় ও কষ্ট লাঘব হয়। এমনিতেই ইনোভেশন ধারণাটি বেসরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত। সাধারণভাবে উদ্ভাবন বা ইনোভেশন বলতে আমরা বুঝব-অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, সেক্টর বা দেশ থেকে কোনো সৃজনশীল চর্চা নিজ ক্ষেত্রে অনুকরণ করা, সম্পূর্ণ নতুন একটি চর্চার অবতারণা করা, প্রশাসনিক পদ্ধতি অথবা সেবাদানের প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করা।

বাংলাদেশে এখন টেকসই উন্নয়নের জন্য নানা কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে। সরকার সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রাখতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কম সময়ে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নির্ঝঞাটে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতার প্রয়োগে নতুন কৌশল উদ্ভাবনের প্রতি বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের কর্ম উদ্যোগে যেহেতু নতুন নতুন বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা যাচাই-বাছাই করা হয়; সেহেতু এর প্রক্রিয়ায় ব্যর্থতার ঘটনা ঘটাও স্বাভাবিক। ইনোভেশন বা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সাফল্য প্রত্যাশী থাকেন সবাই। তবে সব প্রচেষ্টাই সাফল্যে পর্যবসিত হবে, তেমনটি আশা করাটাও বোকামি। ইনোভেশনের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ব্যর্থতার ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। উদ্ভাবনী সক্ষমতা সব সময় ঊর্ধ্বতন নির্বাহীদের মধ্যে থাকবে, তাও নয়। উদ্ভাবনী ধারণা ও উদ্যোগ ঐতিহ্যগতভাবে কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও আসতে পারে। সাধারণত নিম্ন পর্যায় থেকে আগত উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আকারের এবং স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও এটা আসতে পারে। সাধারণত নি¤œপর্যায়ে থেকে আগত উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আকারের এবং স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যাকেন্দ্রিক, যা সরাসরি প্রান্তিক সেবা গ্রহীতাদের জন্য নতুন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে। সরকারি পর্যায়ে উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী নেতৃত্ব, জনপ্রশাসনে উদ্ভাবনী সংস্কৃতির বিকাশ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, গণকর্মচারীদের দক্ষতা, প্রণোদনা এবং ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা জরুরি বলে ধরা হয়।

পৃথিবীব্যাপী এখন দেশে দেশে ইনোভেশন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যাদের কর্মকা- ইতোমধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সেন্টার ফর পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশন, সিঙ্গাপুরের পিএস ২১ অফিস, কলম্বিয়ার সেন্টার ফর সোস্যাল ইনোভেশন, ডেনমার্কের মাইন্ডল্যাব, যুক্তরাজ্যে নেস্টা ইনোভেশন ল্যাব, মেক্সিকোতে ওপেন মেক্সিকো, মালয়েশিয়ার পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ডেলিভারি ইউনিট, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ইনোভেশন ব্যুরো ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যায়। যেসব দেশে ইনোভেশন টিম গঠন করা হয়েছে, তা বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, অবস্থান, গঠন কাঠামো, সংখ্যা এবং অনুসৃত কর্মপদ্ধতি ইত্যাদি বিবেচনায় এ টিমগুলোর মধ্যে বিভিন্নতা রয়েছে। তবে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের দিক থেকে এগুলো একই। আর তা হচ্ছে সমাজের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা সেবাগ্রহীতার সেবাপ্রাপ্তিকে নিশ্চিত করে এবং সেবাপ্রাপ্তির প্রক্রিয়াকে সহজতর করে। উদ্ভাবনের জন্য ইনোভেশন টিমকে আলাদা উদ্ভাবনী উদ্যোগ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। উদ্ভাবনী উদ্যোগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। উদ্ভাবন সংক্রান্ত কাজ এগিয়ে নিতে প্রয়োজন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক শিক্ষা। তবে সবার আগে দরকার উদ্ভাবনের নীতি পদ্ধতি প্রণয়ন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্ভাবন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতা এসে সব প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিতে পারে।

তবে উদ্ভাবনের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকা- এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বর্তমান সরকার খুবই তৎপর। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সব মন্ত্রণালয়, সরকারি দপ্তরে উদ্ভাবনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কারিগরি সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা বিনিময় কর্মসূচিসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে; যা গোটা দেশব্যাপী প্রশাসন, ব্যাংক ব্যবস্থা, প্রকল্প উন্নয়ন, দাপ্তরিক কাজকর্মে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। সব জায়গায়ই এটাকে পজিটিভলি গ্রহণ করা হয়েছে। সবাইকে আজ এটা গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং এর মাধ্যমে জনগণের কাক্সিক্ষত সেবাকে মানসম্মত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। উদ্ভাবনে সফলতার নির্ধারিত বিশেষ কোনো ফর্মুলা বা উপায় নেই। তবে এ ক্ষেত্রে সফলতা পেতে হলে যোগ্য ও কার্যকরী নেতৃত্ব, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অকুণ্ঠ সমর্থন, সহযোগিতা ও প্রণোদনা লাভের পাশাপাশি উদ্ভাবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। আমরা আসলে কী চাইছি? আমাদের গন্তব্য কোথায়? কতদূর যেতে চাই, এসব ঠিক করে তারপর এগোতে হবে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতিষ্ঠানে উদ্ভাবন সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন। উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া সময় সংশ্লিষ্ট সবাইকে এটা স্মরণ রাখতে হবে, এই উদ্যোগ সর্বসাধারণের মঙ্গল এবং কল্যাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত। এর মাধ্যমে জনদুর্ভোগ দূর হয়ে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। অতএব, উদ্ভাবনী উদ্যোগে সমাজের সব শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-নির্বিশেষে সমভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। আগামীতে সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগেই নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে তা প্রয়োগ করতে হবে। গতানুগতিক কর্মপদ্ধতি যা যুগের দাবি মেটাতে পারছে না, যার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে না, যা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা বিশ^মানের পর্যায়ে দেশকে নিয়ে যেতে পদে পদে বিঘœ সৃষ্টি করছে; সেই পুরোনো কর্মপদ্ধতি বাদ দিয়ে নতুন পদ্ধতি, কলাকৌশল উদ্ভাবনে সবাইকে তৎপর হতে হবে। অর্থনীতি, ব্যাংক ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, দুর্যোগ মোকাবিলা, নাগরিক সেবার মান উন্নয়ন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, জ্বালানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ-প্রতিটি সেক্টরেই উদ্ভাবনের জোয়ার সৃষ্টি করতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close