মুহাম্মদ মিজানুর রহমান

  ১৯ অক্টোবর, ২০২১

মতামত

বই পড়ায় আগ্রহ বাড়ানোর কৌশল

জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো বই পড়া। বই ছাড়া বিদ্যার্জন অসম্ভব না হলেও দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার। সেই বই হতে পারে বিদ্যালয়ে পাঠ্য বা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সংগৃহীত। নিজে নিজে পড়ার জন্য। এককথায় জ্ঞান অর্জন করতে গেলেই বইয়ের প্রয়োজন। যদিও মানুষ প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকে। এই শিক্ষা যে, সব ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণ তা কিন্তু নয়। অসম্পূর্ণতা থাকে বলেই অ্যাকাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজন হয়। জ্ঞানের জগৎকে সমৃদ্ধকরণ ও বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে অ্যাকাডেমিক শিক্ষা তথা বইয়ের বিকল্প নেই। এ কারণে গবেষণার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ বই।

সময়ের পরিবর্তনে মানুষের চিন্তা ও কর্মে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে কাগুজে মলাটের একটি বই হাতে নিয়ে দেখতে চায় না। ১০টি বই থেকে সে তার পছন্দ মতো একটি বই কিনতে অনাগ্রহ দেখায়। ক্রমশ মানুষ বইবিমুখ হয়ে পড়ছে। যা মানুষকে ক্রমান্বয়ে জ্ঞানশূন্যর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও তাদের আইসিটিভিত্তিক জ্ঞানে আগের চেয়ে অনেক ডেভেলপ হয়েছে।

আমরা জানি, বই নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা, পছন্দের তালিকার বেশ কিছু বই থেকে একটি বই চয়েজ করা, এতেও মানুষের মেধার বিকাশ ঘটে। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই এই সময় খরচ করতে চায় না। তারা অনলাইনভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে গিয়ে স্বস্তায় তথ্য সংগ্রহ করে নেন। এতে ব্যক্তির মেধার দৈন্যতা তো কাটেই না, বরং আরো বেড়ে যায়। অনেকেই নিজের চাহিদা মোতাবেক কাক্সিক্ষত বিষয়টিকে সাজানো-গোছানো পেলেই তাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এ কারণে একটি বইয়ের পাতায় বিক্ষিপ্তভাবে যে জ্ঞান ছড়িয়ে থাকে তা আত্মস্থ করে নিজের মতো কিছু করে নিতে চান না। তাই অনেকেই এখন তথ্য সংগ্রহের জন্য অনলাইনকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

অনেকের বাসায় বইয়ের সংগ্রহ থাকার পরও তা সেই বইগুলো ব্যবহার না করে অনলাইন থেকে নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য সহজে সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটি খুবই ভয়ংকর। এতে যেমন সে শ্রমবিমুখ করে দিচ্ছে তেমনি অনুসন্ধিৎসু মনটাকে মেরে ফেলছে। তাকে এমন একটি অভ্যাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেসব কাজেই শর্টকার্ট রাস্তা খুঁজতে চাইবে। ফলে একটি বিষয় অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরো ১০টি বিষয় জানতে পাবার সে সুযোগটি থাকে সেটিকে সে নষ্ট করে দিচ্ছে। মূল বই একটি দলিল। অনলাইনের তথ্যগুলো মেরোরি থেকে মুছে গেলে তাকে পুনরায় উদ্ধার করা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বই সেখানে একটি অন্য রকম আনন্দ দেয়। তাই সরাসরি বই থেকে জ্ঞান সংগ্রহ এক অন্য রকম আনন্দ। তাই আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বইমুখী করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বইয়ের প্রতি আগ্রহ অনুভব করানো : শিশুরা সব সময় বড়দের অনুসরণ করে। তাই ওদের বোঝাতে হবে বই থেক অধ্যায়ন একটি মজার বিষয়। এতে করে কাক্সিক্ষত বিষয়ের পাশাপাশি আরো অনেক অর্জন করা যায়। এর মাধ্যমে বইয়ের সঙ্গে এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়। লেখক ও তার সৃষ্টিকর্ম জানার জন্য মূল বই পড়া অনেক আনন্দের বিষয়।

নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস : সন্তানকে বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করানো ভালো উপায় হলো- ছোট বয়স থেকেই তার সামনে বই পড়তে হবে। হয়তো এ সময় সে পড়তে পারবে না। কিন্তু বইয়ের প্রতি তার একটা আকর্ষণ তৈরি হবে। এটিই ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। বাচ্চার জন্য খেলনা কিনছেন এ সময় একটু সতর্ক হোন। বর্ণমালা সংবলিত খেলনা কিনে পারেন। খেলাচ্ছলে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়ে যাবে। বর্তমানে বাজারে আকর্ষণীয় বিভিন্ন বই পাওয়া যায়। সে ওটা নিয়ে খেলা করুন। ও ওর মন মতো কিছু আঁকুক। বড় হয়ে ও বইকে বন্ধু বলে ভাববে।

টিভি দেখার মধ্যে শিক্ষা : টিভি বা এ জাতীয় জিনিস ছাড়া আজকাল ছেলেমেয়েরা থাকতে না। চাইলেও আপনি তাকে ফিরিয়ে রাখতে পারবেন না। আপনার ফিরানোর প্রয়োজন নেই। আপনি নিজেকে একটু পরিবর্তন করুন। এটিও ও জন্য শিক্ষা উপকরণ হয়ে যাবে। ছেলে বা মেয়ে কার্টুন দেখতে পছন্দ করে আপনি এমন কার্টুন নির্বাচন করুন ওর শিক্ষা সহায়ক। ও আনন্দ-শিক্ষা দুটোই পাবে। এ কারণে শিক্ষার উপযোগী ইংরেজি, বাংলা বা ভাষা জ্ঞান ও নৈতিকতা সংবলিত কার্টুন বেছে নিন। সংগীতের জন্য এমন বিষয় নির্বাচন করুন যা আপনি বাচ্চার জন্য রুচিসম্মত বলে মনে করেন।

উচ্চৈঃস্বরে পড়তে উৎসাহিত করুন : আপনি যখন কোনো বিষয় পড়বেন আপনার বাচ্চাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ুন। যেন ও ভালো করে শুনতে পারে আপনি কী পড়ছেন। এতে ও শুদ্ধভাবে পড়া শিখবে। আপনি কীভাবে উচ্চারণ করেছেন ও আপনাকে অনুসরণ করবে। আপনার মতো বলার চেষ্টা করবে। বাচ্চাটি যে কেবল বইয়ের পড়া পড়ল তা নয়, সে আপনার কণ্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গি অনুকরণ করল। তার কাছে কঠিন শব্দটি আর কঠিন রইল না। এই পড়ায় সে অনেক আনন্দ পাবে।

পছন্দের দিকে খেয়াল করুন : একজন অভিভাবকে সব সময় বাচ্চার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হয়। কারণ এটির ওপর ভিত্তি করেই বাচ্চার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ভর করে। আপনার সন্তানটি যে জিনিসটি করতে বেশি পছন্দ করে তাকে সেই পছন্দের দিকেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। ধরুন, আপনার সন্তানটি বেশি বেশি গল্পের বই পড়তে চায় এটা আপনি বুঝতে পারলেন, তখন আপনার উচিত হবে ওই বাচ্চার জন্য তার উপযোগী ভালো মানের গল্পের বই সংগ্রহ করে দেওয়া। তার চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে আপনাকে ক্রমাগত এই কাজটি চালিয়ে যেতে হবে। দেখা যাবে, এক দিন এই অঙ্গনে সে ভালো কিছু উপহার দেবে।

চাপ প্রয়োগ না করা : কখনোই কোনো বিষয়ে বাচ্চাকে চাপ প্রয়োগ করবেন না। যদি মনে করেন, আপনার শিশুটি কোনো একটা ব্যাপারে ভুল করছে আপনি তাকে বুঝিয়ে বলুন। শিশু আপনার কথার গুরুত্ব দেবে। কোনো বিষয়ে শিশুদের ভুল ধরিয়ে দিলে তারা সে ধরনের কাজ আর করতে চায় না।

পড়াকে আনন্দদায়ক করা : পড়া তখনই শিশুরা বোঝা মনে হয় যখন সে কী পড়ছে নিজেও তা বুঝতে পারে না। এ কারণে যে বিষয়টি সে পড়বে অবশ্যই যেন বুঝে পড়বে। তাহলে পড়ার প্রতি তার কোনো অনাগ্রহ তৈরি হবে না। সবচেয়ে ভালো যে বিষয়টি সে পড়ল সে বিষয়ের ওপর যদি কোনো তথ্যচিত্র বা ভিডিও থাকে তা তাকে দেখানো। বা অন্য কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করা। যেন তার পঠিত বিষয়গুলো একটি বাস্তবরূপ নিয়ে তার সামনে প্রকাশিত হয়।

বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া : জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষাই মানুষকে বেশি প্রভাবিত করে। যা মানুষ সহজে ভোলে না। এ কারণে যখন একটি বাচ্চা বইয়ে জাতীয় জাদুঘর সম্পর্কে জানল, একবার যদি তাকে ওখান থেকে ঘুরিয়ে আনা যায় এই স্মৃতি কখনো তার স্মরণ থেকে মুছে যাবে না।

লাইব্রেরি ওয়ার্ক করানো : শিশুকে কম বয়সেই লাইব্রেরিতে যেতে দিন। সে ওখানে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে বই পড়ুক। তার পছন্দের বই খুঁজুক। এতে তার জানার আগ্রহ বেড়ে যাবে। গ্রুপ স্টাডি করবে। তাই বাচ্চাকে একটি লাইব্রেরি কার্ড বানিয়ে দিন। আর যারা লাইব্রেরি পরিচালনা করে তাদের বলুন তারা যেন শিশুদের উপযোগী বই, ম্যাগাজিন ইত্যাদি সংগ্রহে রাখে। প্রয়োজনে আপনি তাদের সহায়তা করুন।

আপনি নির্দেশনা দিন : যে বইগুলো এক বসাতে পড়ে শেষ করতে পারবে সেটা বাচ্চাকে ওভাবেই পড়ার নির্দেশনা দিবেন। যে বইগুলো আকারে বড় ও পৃষ্ঠায় বেশি তা একবারে শেষ করতে পারবে না। এজন্য তাকে বলতে হবে তুমি যে পর্যন্ত আজকে শেষ করবে পরের দিন আবার ওখান থেকেই শুরু করবে। অন্য দিকে এ বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হবে বাচ্চা যে বইটি পড়তে চায় না, ওকে দিয়ে তা না পড়ানোই ভালো। বরং পরিবর্তন করে অন্য একটি বই সন্তানের হাতে তুলে দিন। আর যদি মনে করে যে, এ ধরনের বই পড়া তার দরকার সে ক্ষেত্রে অনুরূপ বিষয় সংবলিত ভিন্ন লেখকের ভালো মানের বই চয়েস করুন। যা পড়ে শিশু মজা পাবে।

বাচ্চাকে উৎসাহিত করুন : যে বইগুলো পড়া হয়ে গেছে তার ওপর একটি রিভিউ নিয়ে নিন। তাকে একটি খাতায় পঠিত বইটি সম্পর্কে একটি মন্তব্য লিখতে বলুন। সে বইটির শব্দ চয়ন, বাক্য বুনন, লেখার ধরন, সাহিত্য মান, বিষয়ের যথার্থতা, বইটির উপযোগিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মন্তব্যে লিখবে। এতে তার অন্তরদৃষ্টি প্রসারিত হবে। সে যে কিছু শিখতে পারছে, এ বিষয়ে তার নিজের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হবে।

আলাদা সময় বের করুন : শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য তার অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার বাইরে প্রতিদিন কম করে হলেও ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় বের করতে হবে। এ সময়ে সে ক্লাসের পড়ার বাইরে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তার পছন্দের কোনো বিষয় নিয়ে পড়বে। এভাবে করলে একসময় এটি তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে।

বাচ্চাকে পুরস্কৃত করুন : বাচ্চাকে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য মাঝে মধ্যে ঘরোয়া পরিবেশে তার কোনো ভালো কাজের প্রশংসাস্বরূপ তাকে উপহার দিন। এতে তার উদ্যমতা বাড়বে। এ ক্ষেত্রে আপনার প্রথম চয়েস থাকবে বই। বাচ্চা যখন অন্য কাউকে কিছু উপহার দেবে আপনি তাকে বই দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন। তবে এর সঙ্গে তাকে অন্য কিছুও দেবেন। মনে রাখবেন, আপনার পুরস্কারে বই যেন একটি বিশেষ স্থান দখল করে নেয়।

আপনার সন্তান আপনার ভবিষ্যতের সম্বল। তাকে যদি সঠিকভাবে মানুষ করতে না পারেন, আপনার অনেক সম্পদ থাকতে পারে, সুনাম থাকতে পারে, সেটি আসলে কতটা কাজে আসবে, সে বিষয়ে একটু সন্দেহ থেকে যায়। তাই সন্তানকে সময় দিন। স্নেহ, মমতা দিয়ে বেড়ে উঠার সুযোগ দিন। আপনার সন্তান পড়ছে দেখছেন আপনিও তার সঙ্গে একটু বসুন। দু-এক পৃষ্ঠা পড়ুন। তার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করুন। এটিও তার মানসিক শক্তি ও মেধা বিকাশে অনেক সহায়ক।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close