রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পর্যবেক্ষণ

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার প্রযুক্তি

আধুনিক প্রযুক্তি সারা বিশ্বকে জয় করেছে। প্রযুক্তির অবদানে বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয়, প্রযুক্তি মানুষকে যেমন উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে তেমনি কঠিন কাজগুলোকে করেছে সহজ। তা ছাড়া প্রযুক্তির আকাশছোঁয়া সাফল্যের বিপরীতে রয়েছে সভ্যতা ধ্বংসের হাতছানি। তবে এর কুফল মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তার জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে। কেননা মানুষ যদি প্রযুক্তির উদ্ভাবন করতে পারে তাহলে নিয়ন্ত্রণও করতে পারবে। সুতরাং প্রযুক্তির কুফল বর্জন করে প্রযুক্তিকে মানবকল্যাণে প্রয়োগ করে বিশ্বকে আরো উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে এগিয়ে চলেছে আধুনিক মানুষ। মধ্যযুগের দেববিশ্বাস ও ভক্তি আধুনিক জীবনে মানুষের প্রতি বিশ্বাস এবং মর্ত্যময়তায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই মর্ত্যময়তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ। আধুনিক জীবনে যুক্তিবোধ ও কার্যকারণ পরম্পরা জ্ঞান থেকেই শুরু হলো বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান মানুষকে দিল মধ্যযুগীয় কুসংস্কার থেকে মুক্তি, জগৎ ও জীবনের প্রতি এক আলাদা মমত্ব। এই মমত্ব থেকে দেবতাই সব করতে পারে এই বোধ অপসৃত হলো, তার জায়গায় এলো মরজগতের মানুষের অপার মহিমার প্রতি আস্থা। মানুষ আর অযথা দেবতার ওপর ভরসা না করে কিংবা প্রকৃতির ওপর শুধু আস্থা না করে বিকল্পের সন্ধান করতে লাগল। ফলে ব্যবহারিক জীবনে কিংবা নিত্যনৈমিত্তিক কার্যে বিজ্ঞানের অবদানকে গ্রহণ করতে থাকল মানুষ। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান-নির্ভরতা মানুষকে করল কৃত্রিম, বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ মানুষের শান্তি কেড়ে নিল। বিজ্ঞান মানবসভ্যতার এক বিশিষ্ট অবদান। মানব কল্যাণে বিজ্ঞানের অবদান যে কত ব্যাপক তা প্রতিদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করা যায়।

বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে এসেছে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও এসেছে স্বাচ্ছন্দ্য। আদিম যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানবসভ্যতার বিকাশ ঘটেছে, তার মূলে রয়েছে বিজ্ঞান। বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্র বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। মানব সমাজের যে দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়, সেদিকে শুধু বিজ্ঞানের মহিমাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানের বলে মানুষ জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষ জয় করেছে। মানুষের সংকট নিরসন ও অসংখ্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিনোদনের বহু অভাবনীয় কৌশল আবিষ্কার করেছে। বিজ্ঞান আর সব রোগ-শোককে জয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের একটি বিশিষ্ট আবিষ্কার বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ মানবসভ্যতাকে অত্যাধিক দ্রুতগতিতে এগিয়ে দিয়েছে। বিজ্ঞানের দেশের খবর অন্য দেশে নিমিষের মধ্যে পৌঁছে দিচ্ছে। দূরত্ব কমে সারা পৃথিবীকে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। কাগজ, মুদ্রণযন্ত্র ইত্যাদি আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষা ক্ষেত্রে এনে দিয়েছে ব্যাপক প্রসারতা। পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান এনেছে গতিময়তা। মূলত বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমাদের আধুনিক জীবন যাত্রার সুখ-সমৃদ্ধি বর্ধন। বিশেষভাবে জ্ঞানী যিনি তিনিই বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানীদের নানা আবিষ্কার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জন্ম দিয়েছে আধুনিক যুগের। তাই আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ। মানুষ তার যুগ যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনার অনবদ্য ফসল দিয়ে সভ্যতার এ বিশাল ইমারত গড়ে তুলেছে। নিজের প্রাণশক্তি তিল তিল সঞ্চিত করে, বুকের রক্ত বিন্দু বিন্দু ঢেলে দিয়ে সে রচনা করেছে সভ্যতার এ তিলোত্তমা মূর্তি। সে সভ্যতার বেদীমূলে দিয়েছে বাহুর শক্তি, মস্তিষ্কের বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি এবং হৃদয়ের ভালোবাসা। বিজ্ঞান মানুষের অতন্দ্র সাধনার ফসল। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, সভ্যতার পদক্ষেপকে করেছে দ্রুততর, পৃথিবীকে করেছে ছোট। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে অনিঃশেষ শক্তির অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা।

সভ্যতার প্রত্যুষ লগ্নের সেই অসহায় মানুষ আজ অসীম শক্তিধর। হিংস্র পশুর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য পাথর আর গাছের ডাল ব্যবহার করতে করতে একসময় বল্লম, তীর, ধনুক, ঢাল তলোয়ারের ব্যবহার করতে শিখছে। আধুনিক বিজ্ঞান সময় ও দূরত্বকে জয় করেছে। জেমস ওয়ার্ট স্টিম ইঞ্জিন ও জর্জ স্টিভেনশন রেলগাড়ি আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানের বলে মানুষ পানি, স্থল ও অন্তরীক্ষ জয় করেছে। বিজ্ঞান আজ আমাদের জীবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। পরিধেয় বস্ত্র থেকে ঘরবাড়ি, পথঘাট, ওষুধপত্র, কৃষিজ, খনিজ ভোগ্যপণ্য সবই তো বিজ্ঞানের প্রযুক্তি বিদ্যার ফসল। মানুষের চিন্তাচেতনা খুব সহজে মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং মানুষে মানুষে চেনা জানা হচ্ছে ঘনিষ্ঠভাবে। উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা ও জাতীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করার জন্য চলচ্চিত্র, ভ্রাম্যমাণ চলচ্চিত্র সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন আজ বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় সর্বক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে কম্পিউটার। বিজ্ঞানীদের বিস্ময়কর আবিষ্কার প্রযুক্তি। প্রযুক্তির সংস্পর্শে পৃথিবীতে নবচেতনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবী দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে কাজ সমাধান করতে পারে। প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষ অল্প পরিশ্রম করে অধিক কাজ করতে পারে এবং আর্থনীতিক উন্নতিও হয় দ্রুত। তাই বিশ্ব এখন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। এক দেশে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি অন্য দেশে রপ্তানি করে আর্থিক উন্নতি করছে। তা ছাড়া কোনো কোনো দেশ প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য কাঁচামাল রপ্তানি করে আর্থিক উন্নতি করছে। প্রাগৈতিহাসিক মানবের অগ্নি আবিষ্কারের দিন থেকে মানবজীবনে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষের অতন্দ্র সাধনা বিজ্ঞানকে করেছে সমৃদ্ধ। সভ্যতাকে করেছে জঙ্গম। মুঠোর মধ্যে এখন তার পারমাণবিক শক্তি। ডাঙায় ছুটছে মোটর ট্রেন। পানির ঢেউয়ের ঝুঁটি ঝাপটে ধরে জাহাজ চলছে ছুটে। আকাশে তোলপাড় করে উড়ে চলছে, শব্দের চেয়েও দ্রুতগামী বিমানপোত। মহাশূন্য পাড়ি দিচ্ছে রকেট স্ফুটনিক আকাশযান। আজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবিসংবাদিত প্রভুত্ব।

কিন্তু এই বিজ্ঞান একদিকে যেমন মানুষের কল্যাণ সাধন করে আসছে, অন্যদিকে তেমনি এনেছে বিভীষিকা। এটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা ইত্যাদি মারাত্মক মারণাস্ত্র আবিষ্কারের ফলে মানবসভ্যতা আজ ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার বোমা বর্ষণের পর জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের ধ্বংসযজ্ঞ তার বাস্তব প্রমাণ। মানবসভ্যতাকে পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে বিজ্ঞান। সর্বোপরি, বিজ্ঞান আমাদের জীবনে সুখ সমৃদ্ধি আনয়ন করেছে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে করেছে গতিময়। কিন্তু মানুষ যদি বিজ্ঞানের কল্যাণকর শক্তিকে অপব্যবহার করে তবে দোষ বিজ্ঞানের নয়, দোষ মানুষের। মানুষ যদি বিজ্ঞানের শক্তিকে অপব্যবহার না করে শুভবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয় এবং বিজ্ঞানকে সভ্যতার বিকাশে কাজে লাগায় তবে বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদই হবে। দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রভাব মানুষের শুধু যে কল্যাণ করেছে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু অকল্যাণকেও ডেকে আনছে। যন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করতে গিয়ে মানুষ ক্রমশই হয়ে উঠছে শ্রমবিমুখ। সে মানসিক পরিশ্রম যে পরিমাণে করছে, শারীরিক পরিশ্রম করছে সে তুলনায় কম। ফলে তার জীবনে নতুন কিছু রোগ ও উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং এসব কিছুর চেয়েও বড় কথা তার জীবনে কৃত্রিমতা ঘনীভূত হচ্ছে। প্রকৃতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত কাজ করার ফলে তার দেহ ও মনের স্বাভাবিক কিছু প্রবৃত্তি ক্রমশই যেন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। সমাজের বাইরের জৌলুস বাড়ছে কিন্তু সে অনুপাতে স্নেহ-প্রেম-মায়া-মমতা ইত্যাদি মানুষের সদগুণগুলোর বিকাশ ঘটছে না। মানুষে মানুষে ও মানুষে প্রকৃতিতে বিভেদ বাড়ছে ক্রমাগত আর মানুষ হয়ে উঠছে যান্ত্রিক।

এ ছাড়া সমস্যার অন্যদিকও আছে। আর্থিক সঙ্গতির অভাবের ফলে পৃথিবীর বহু দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানের নানাবধি আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত। বিজ্ঞান-বিদ্যার কাছ থেকে আরাম আয়েসের উপকরণ পাওয়া তো দূরের কথা, তাদের দুই বেলা দুমুঠো অন্ন পর্যন্ত জোটে না। কিন্তু দোষ কার? বিজ্ঞানের না যারা বিজ্ঞানকে স্বার্থলোলুপ দানবীয় প্রবৃত্তি চরিতার্থতার জন্য প্রয়োগ করে তারা? সেই স্বার্থপর পিশাচরূপী মানুষের হাতেই বিজ্ঞান বারবার তার কল্যাণ ব্রত থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পৃথিবীতে করছে নরমেধ যজ্ঞের আয়োজন। একবিংশ শতাব্দীর অপরাহ্ন প্রহরের দাবিই হলো এসব পিশাচদের হাত থেকে বিজ্ঞানের দাসত্ব মুক্তি। অর্থাৎ এর জন্য চাই মানবিক কল্যাণ বোধের উদার উন্মেষ। তা যদি না হয় যদি বিজ্ঞান স্বার্থপর লোভসর্বস্ব প্রভুত্বকামী মুষ্টিময়ের ঘরে বন্দি হয়ে থাকে তবে বিজ্ঞানের সব সাধনা ও সিদ্ধি হয়ে উঠবে পৃথিবী ধ্বংসের অন্যতম একটি কারণ।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close