আসহাবে কাহাফ

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

মুক্তমত

বর্নমালা, আমার দুঃখিনী বাংলা বর্ণমালা

দিনপঞ্জির পৃষ্ঠা ঘুরে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের বাঙালি মনে এক ধরনের ভাষাপ্রীতি উথলে ওঠে। পক্ষান্তরে, সঠিক ও নির্ভুল বাংলা ভাষাচর্চার প্রতি রয়েছে এক অলিখিত হীনম্মন্যতা। এমতাবস্থায় বাংলা ভাষা, বাংলা বর্ণমালার সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করার মতো যোগ্যতা ও মনমানসিকতা কোনোটাই আমার নেই। যা বলব, তা মূলত ভাষার প্রয়োগবিধি ও ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রতি আমাদের উদাসীনতা ও অবহেলার মতো দৈন্যদশা নিয়ে। বাঙালি মাত্রই আমাদের জানা, বর্তমান বিশ্বে প্রায় সাত হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যবহারিক অবস্থান পঞ্চম। বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করে বললে বলতে হয়, পৃথিবীর প্রায় ৭০০ কোটি লোকে বাংলা ভাষায় কথা বলে। ভাষার সংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, তবে ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা, ‘সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস’-এর প্রতিবেদন মতে, পৃথিবীতে মোট ভাষার সংখ্যা ৬৯০৯টি।

ভাষা নিয়ে গর্ব করে আরো বলতে গেলে আমরা বলতে পারি, ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে তালিকাবদ্ধ ১৮টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগে ও ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া দেখা যায়, পৃথিবী বিখ্যাত যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দরে বাংলায় ঘোষণা দেওয়া হয়। অথচ এত মহিমায় ভাস্বর ভাষাটির নিজ দেশে কী এক করুণদশা!

আমি বাংলা ভাষার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে কথা বলব না। সহজ কয়েকটি বিষয়ে বিজ্ঞজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই শেষ করব। আমাদের বাংলা ভাষাটি ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর শেষ স্তর মাগধী প্রাকৃত কিংবা প্রাকৃত অপভ্রংশের থেকে আগত। এখানে আমি মাগধী এবং অপভ্রংশ দুটোকেই উল্লেখ করছি, কারণ বৈয়াকরণিকদের কারো কারো মতে মাগধী প্রকৃত আবার কারো কারো মতে, প্রকৃত অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি আর ব্রাহ্মীলিপি থেকে উৎপত্তি ঘটে আমাদের বাংলা বর্ণমালার। যেহেতু ভাষাচর্চা ও প্রয়োগবিধি নিয়ে কথা বলছি, তাই প্রথমেই বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার পরিচয় তুলে ধরছি।

বর্তমানে প্রচলিত বাংলা বর্ণমালায় মোট বর্ণের সংখ্যা; অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, শ, ষ, স, হ, ড়, ঢ, য়, ৎ, ং, ঃ, ঁ পর্যন্ত ৫০টি। যদিও এ সংখ্যাটি আগে আরো বেশি ছিল; অর্থাৎ আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন স্বরবর্ণে ‘ঋ’-এর পরে ‘৯’ (লি) এবং ব্যঞ্জনবর্ণে ‘ল’-এর পরে ‘ব’ (অন্তস্থঃব) নামে দুটি বর্ণ শিখেছিলাম। যা কালভেদে বিলুপ্ত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়; বাংলা বর্ণমালার এই সংখ্যাটি কোনো একসময় ৫৭ ঘরে পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাংলা বর্ণমালার এসব বিলুপ্ত ও বর্জিত বর্ণগুলো মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশু শিক্ষা’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ এবং রাম সুন্দর বসাকের’ বাল্যশিক্ষা’ বই থেকে আমরা জানতে পারি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, হজরত মুসা (আ.)-এর যেমন আল্লাহর কাছ থেকে আমাদের কষ্ট হবে জেনে, নামাজকে কমিয়ে ৫০ রাকাত নিয়ে এলেও আমরা নামাজের প্রতি অনীহা প্রদর্শন করি, তেমনি বাংলা বর্ণমালাকে সহজ-সাবলীল ও নির্ভেজাল ত্রুটিহীন করার জন্য কমিয়ে ৫০টি করার পরও বর্ণমালা ও ভাষার প্রতি আমাদের সেই একই ধরনের অনীহা রয়ে গেছে। শুধুই তা-ই নয়, বর্ণমালাকে সহজভাবে আত্মস্থ করার জন্য বর্তমানে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ, স্বরবর্ণ ১১টি, ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯টি, ঘোষ ধ্বনি, অঘোষ ধ্বনি, বর্গীয়বর্ণ ২৫টি, উষ্মবর্ণ ৪টি, পরাশ্রয়ী বর্ণ ৩টি, পূর্ণমাত্রার বর্ণ ৩২টি, অর্ধমাত্রার ৮টি, মাত্রাহীন বর্ণ ১০টি ইত্যাকার নামে ভাগ-বণ্টন করেও ভাষায় বর্ণমালার সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগে আমাদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু কেন!

এবার আরেকটা ভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি। হঠাৎ করে যদি কেউ আপনাকে প্রশ্ন করে বসে, বাংলা ভাষায় শব্দের সংখ্যা কত? ঠিক তখনই আপনাকে ভ্যাবাচেকা খেতে হবে না! চটজলদি উত্তর দেবেন, চার লাখ! হ্যাঁ, চার লাখ! সংখ্যাটি কমবেশি হতে পারে। কেননা, এযাবৎকালের অভিধানগুলোয় বড়জোর সংযোজিত শব্দের সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি। তবে, এ কথা দিনের আলোর মতো সত্য, বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার অফুরন্ত। সুতরাং শব্দের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকবে। আরেকটি কথা, শব্দের সংখ্যা নিয়ে যেমন মতভেদ থাকবে, তেমনি দু-একটা শব্দের বানান নিয়েও মতভেদ থাকা স্বাভাবিক। তেমনি একটা মতভেদের গল্প নিয়ে এগুনো যাক। বলুন তো, ছোট গরু কি বড়ো গোরু হতে পারে না!

হুম..., হয় তো! আমাদের গত বছরের ছোট গরুটা এখন মোটাতাজা আস্ত একটা বড় গরু হয়েছে! সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে বহু সম্মানিত ব্যক্তি থেকে শুরু করে দুই লাইন প্রমিত বাংলা বানানবিধি অনুযায়ী লিখতে না পারা ব্যক্তিটিও অনেক মজার মজার স্ট্যাটাস লিখেছে। বাংলা একাডেমির মতো একটা প্রতিষ্ঠানকে নিয়েও তারা মুখরোচক কথাবার্তা আকারে ইঙ্গিতে বলেছে। তাদের স্ট্যাটাস, যুক্তিতর্ক পাঠান্তে আমার কবি জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার একটা লাইন মনে পড়ে গেল। লাইনটা এই যে, হাতেতে না মারিলেও মুখেতে মারিতো শতো! (সামান্য এদিক-সেদিক হতে পারে, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি কাম্য।) ঠিক, প্রিয় ফেসবুক বন্ধুরা, বাংলা একাডেমিকে ঢাকায় গিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম বা ভেঙে দিতে না পারলেও কথাবার্তায় ও যুক্তিতর্কে জাহান্নামের কঠিনতর শাস্তির মতো সহস্রাধিকবার ভেঙেছে আবার গড়েছে। কিন্তু কেন ভাই? কারণ, বাংলা একাডেমি অনেক আগে পরিবর্তিত কিছু বানানকে বর্তমান সংস্করণে হালনাগাদ করেছে। এই হালনাগাদ করা শব্দগুলোর সঠিক সংখ্যা ঠিক কত, তা আমার জানা নেই। আর সবকিছুই আমার জানতে হবে এমনও কথা নেই। না জানার মধ্যেও একটা শব্দ খুব করে জেনে গেলাম ‘গোরু’! কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে দেখলাম, কীভাবে যেন সেসব শব্দভা-ার থেকে রোজার ঈদের শেষে, কোরবানির ঈদের আগে এসে ছোট গরু ও বড়ো গোরু নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আমাদের অবস্থা কী! হয়তো, পক্ষে-বিপক্ষে দু-একটা স্ট্যাটাস দিয়ে শেষ করছি। কেউ কেউ বাংলা একাডেমির কর্তাদের জাত উদ্ধার করতেও বাকি রাখছি না। আমজনতার এহেন অবস্থা দেখে অন্যদিকে বাংলা একাডেমির ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! অথচ, সঠিক ও গ্রহণযোগ্য মতামত কিংবা সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ এগিয়ে এলো না। অবশ্যই কেউ কেউ বলেছেন, বাংলা ভাষার নিয়মকানুন এসব বাংলা একাডেমির কাজ, আমাদের নয়। যাক বাবা, এ যাত্রায় এ কথা দিয়ে বাঁচা গেল! আসল কথা ভিন্ন!

বাংলা একাডেমি, বাংলা ভাষা ও বানানের প্রমিত নিয়ম এবং ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধারণা অত্যন্ত নড়বড়ে! ফলে, আমরা ধরি মাছ না-ছুঁই পানি এ জাতীয় মন্তব্য করে দায়িত্ব এড়িয়ে যাই। বাস্তবতা ছিল, আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে যেমন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করেছি, তদ্রƒপ সচেতনতা ও সম্মিলিত উদ্যোগে প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আমরা সেই, যা আছে তা নিয়ে সুখী! যে যখন যেভাবে পারছে নিজের প্রচার-প্রসার করে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমির কর্তাব্যক্তিরাও এর বাইরে না।

এই যে গোরু বানান নিয়ে যারা চিল্লাপাল্লা করলেন, তারা কেউ কি জানেন, বাংলা একাডেমি কবে কীভাবে প্রতিষ্ঠা হয়েছে? কেউ প্রমিত বানানের নিয়মগুলো জানে? শুধু আবুলের ছেলে বাবুলের টাইমলাইনে দেখলেন বাংলা একাডেমির অভিধানে গরুকে গোরু লিখছে; অমনি তারাও গোরুর মতো লাফালাফি শুরু করে দিয়েছেন। হ্যাঁ, আমি জানি, ঈদ এবং গরু আমাদের কাছে অতিপরিচিত এবং চাষাভুষার শব্দ! অর্থাৎ, একজন প্রান্তিক কৃষক এবং দিনমজুরের ন্যায় এসব শব্দ আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তাই পরিবর্তন নিয়ে কথা উঠছে, কতকালের পুরোনো শব্দ, পরিবর্তনে না করলেইবা ক্ষতি কী? বাংলা একাডেমি এত দিন কী করেছে!

যাই হোক, আমি আর গরু কিংবা গোরু বানান নিয়ে ঠিক-বেঠিকের দিকে যাচ্ছি না। কেননা, গরু কিংবা গোরু যে নামেই ডাকি বা লিখি সেটি গরুই থাকছে। এর চেয়ে বড় সমস্যা হলো, যখন আমরা লিখি বা দেখি, কেউ তুমিকে ইংরেজিতে টিইউএমই দিয়ে লিখে, ভাইকে বিএওয়াই দিয়ে লিখে, অথবা দেখি ‘তুমী খোতাই জাচ্ছো, পাকা দানের গ্রাণে ঘুম আসে না, আমাকে কমা করে দাও, যখন জোরে জোরে ভাতাশ ভইছে, তখন ভয়ে আমাদের গাঁ সিউরে উঠছে কিংবা নাম ফলকে লেখা আছে।’ ডা. মো. আবদুল বাসেদ স্থাপিত : ১৯৯৯ ইং সাল ইত্যাদি। আমার তো অলিগলিতে বড় বড় সাইনবোর্ডে যাদের নাম বড় বড় করে লেখা আছে, কবিঃ মোঃ আবুল তাদের জিজ্ঞেস করতে মন চায়, ভাই, আপনার নাম কি কবি বিসর্গ (ঃ) মো বিসর্গ (ঃ) আবুল নাকি? হায় রে আমার বর্ণমালা, দুঃখিনী বাংলা বর্ণমালা! বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে তোমার এ কি হাল হয়েছে আজ! শুধু ‘ই-কার ও ঈ-কার, উ-কার ও ঊ-কার, ক-ও-খ, গ-ও-ঘ, চ-ও-ছ, প-ও-ফ, ঃ ও : এর মতো গুটিকয়েক বর্ণ ও চিহ্নের পার্থক্য করতে না পারায় দিনে দিনে আমাদের বানানের অবস্থা হচ্ছে বৃদ্ধের দাঁতের মতো নড়েবড়ে ভঙ্গুর। অনেক বিজ্ঞজনই জানে না, বর্ণের পরিবর্তনের কারণে শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে, আবার শব্দের অর্থের পরিবর্তনের কারণে বাক্যের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। যেমনÑ কেউ একজন লিখল, ‘আমি আপণ পড় নিয়ে পর দেশে কোণ রকম পরে আছি।’ দেখুন, বাক্যটি সঠিক করে লিখলে লিখতে হবে, ‘আমি আপন-পর নিয়ে পর দেশে কোনো রকমে পড়ে আছি।’ এ বিষয়গুলো সবাইকে বুঝতে হবে যে, ‘পর’ আর ‘পড়’, ‘আপণ’ আর ‘আপন’, ‘কোণ’ আর ‘কোনো’ এর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। তাই, আমি তিনটি শব্দের ও প্রায়োগিক অর্থের ব্যবধান দেখাচ্ছি। কেননা, বঙাল দেশের বাংলা ভাষার হলো যত দুর্গতি! এখানে শেখার আগ্রহ তো কারো নেই, বরং যেটা আছে সেটা হলোÑ কেউ শিখতে চাইলে, শেখাতে চাইলেই তাকে ঘাড় চেপে ধরে যত টানাটানি! আমি প্রথমেই তিনটা শব্দ লিখছি

১. কোণ (ঈড়ৎহবৎ), ২. কোন (ডযরপয), ৩. কোনো (অহু) আশা করি, আমি এতটুকু লেখায়ই অনেকে বানানের ভুল ও শুদ্ধতা ধরতে পেরেছেন। এবার তিনটা উদাহরণ দেব। কারণ, আমি অনেক উচ্চশিক্ষিত ভদ্রজনকেও দেখেছি, এই বানানগুলো ভুল করতে।

উদাহরণ : ঘরের কোণে (পড়ৎহবৎ) লুকিয়ে ভাবছি যেকোনো (ধহু) উপায়ে কোন (যিরপয) জিনিসটা চুরি করব? অথবা ১. ছাতাটা ঘরের কোণে (পড়ৎহবৎ) রেখে দাও। ২. তুমি কোন (যিরপয) বইটা পড়বে?

৩. তোমার কাছে কোনো (ধহু) বই আছে? অথচ, মজার বিষয় যেদিকেই তাকাই দেখি, প্রায়ই কোণ, কোনো এবং কোনোর বানান এক ও অভিন্ন।

আপাতত, আর কিছু বলছি না! আমাদের বাংলা ভাষার বানানের ও উচ্চারণের সামগ্রিক সমস্যা ও সমাধান তুলে ধরেই শেষ করছি।

১. আমাদের বানান ভুলের অন্যতম কারণ, আমরা বানাবিধি কিংবা ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে পড়াশোনা করলেও বাচিকতা কিংবা উচ্চারণবিধি নিয়ে তেমন একটা পড়াশোনা করি না।

২. আমাদের বানানবিভ্রাটের আরো একটি অন্যতম কারণ শব্দের বানান ও উচ্চারণের ভিন্নতা। যেমন : আমরা লিখি আত্মা (আ+ত+ম+আ), অথচ পড়ি, আত্তা (আ+ত+ত+আ), বিশ্ব (ব+ই+শ+ব) কিন্তু পড়ি,

(ব+ই+শ+শ) ইত্যাদি।

৪. আমাদের বাংলা ভাষায় একাদিক বর্ণের উচ্চারণ ধ্বনি এক, আবার একই বর্ণের রয়েছে একাধিক উচ্চারণ। যেমম : শ, ষ, স এই তিনটা বর্ণের উচ্চারণ আমাদের কাছে, ‘শ’ অন্যদিকে অ, এ এসব বর্ণের দুটো করে উচ্চারণ রয়েছে।

৫. আমাদের পাঠ্যসূচিতে ইংরেজি ভাষার মতো বাংলা ভাষার যতি (বিরাম) চিহ্নের ব্যবহার অনুশীলনে বিন্দু পরিমাণ ব্যবস্থা নেই, নম্বর বরাদ্দ নেয়।

হ্যাঁ, বানান কিংবা উচ্চারণের এত এত সমস্যা হয়তো এক দিনে এক বছরে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব না; তবে সবার সদিচ্ছা থাকলে একযুগে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। তার জন্য আমাদের শুধু কয়েকটি কাজ করতে হবে। এক. আমাদের দৈনিন্দন জীবনে সবাইকে সবত্র সতর্কতার সঙ্গে ভাষার ব্যবহার করতে হবে। দুই. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা শিক্ষকদের ভাষার বানান ও উচ্চারণ বিধিমালার ওপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যথেষ্ট যোগ্য করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করাতে হবে। তিন. বাংলা বর্ণমালার প্রতিবর্ণীকরণের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক পর্যায়ে ইন্টারন্যাশানাল ফোনেটিক অ্যালফাবেট (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ চযড়হবঃরপ অষঢ়যধনবঃ)-এর নির্দিষ্ট পাঠদান করতে হবে। অন্যথায়, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় সকাল-সন্ধ্যা যেভাবে ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে বাংলা লেখা হচ্ছে, তাতে না জানি কোনোদিন বাংলাদেশ (নধহমষধফবংয), ভাঙলাডেস (নযধঘমষধউবঝ) হয়ে যায়! এ ছাড়া, মুরাদ টাকলার গল্প-তো আমাদের সবারই জানা! সে যাই হোক, যদিও দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষা চালুর লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ প্রণয়ন করা হয় ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’। এতে বলা হয়, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ এই আইনে আরো বলা হয়, কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে সেটি বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। শুধু তা-ই নয়, কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি এই আইন অমান্য করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু আক্ষেপের সঙ্গে আজকের দিনে এসেও আমাকে বলতে হচ্ছে, শাস্তি না হোক, আমরা চাই, সঠিক বাংলা ভাষা চর্চা হোক। সঠিক বাংলা ভাষার চর্চা ও প্রচার, প্রসার নিয়ে সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের অধীনস্থরা যার যার ঊর্ধ্বতনের কাছে জবাবদিহির আওতায় আসুক। ধীরে ধীরে আমাদের আহা মরি বাংলা ভাষা হয়ে উঠুক অমর, অক্ষয় ও চিরঞ্জীব ভাষা।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close