reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পর্যালোচনা

বৈচিত্র্য পৃথিবীর বিচিত্র রাজনীতি

রায়হান আহমেদ তপাদার

অদৃশ্য করোনা নামক এক ভাইরাস আজ বিশ্বকে শাসন করছে। পাল্টে দিয়েছে বিশ্বরাজনীতির মানচিত্র। এই তো কয়েক দিন আগেও বিশ্বরাজনীতিকে নেতৃত্ব দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ করোনার ভয়াবহ ছোবলে পর্যুদস্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল ভারী হচ্ছে। এই মিছিলে সবার আগে রয়েছে ইতালি, এরপর স্পেন। এদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে, আক্রান্ত ব্রিটিশ সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস এবং জনসনের মন্ত্রিসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রীও। কী অসম্ভব গতিতে বিশ্বের তাবৎ রাষ্ট্রনায়কদের চোখের ঘুম হারাম করে করোনা এগিয়ে চলছে তার আপন মহিমায়! জনগণ নয়, গণতন্ত্রের সংজ্ঞা এখন পরিবর্তিত হয়েছে। প্রয়াত আব্রাহাম লিংকনের জনগণ কর্তৃক, জনগণ দ্বারা, জনগণের জন্য গণতন্ত্রের এ সংজ্ঞা এখন খুব কষ্ট করে পৃথিবীর দু-একটি দেশে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান প্রভুদের ক্রীড়নক শুধু রাষ্ট্রপ্রধানরাই নয়, এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহও। কারণ তাদের চাকরি কিংবা বেতন নির্ভর করে এদের ওপর। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের অবস্থান বিশ্লেষণ করলে এটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এইতো করোনাযুগে এক অ্যাপের নাম টিকটক। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-টুইটার জমানায় এই অ্যাপের জনপ্রিয়তাও ছিল তুঙ্গে। আমজনতা থেকে সেলিব্রিটি, টিকটিকে সোশ্যাল উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। কিন্তু কেন বিশ্বরাজনীতিতে নয়া জায়গা করে নিল এই অ্যাপ? উত্তর খুঁজলে কারণ হিসেবে উঠে আসে চীনের নাম।

ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ডিরেক্টর সি রাজা মোহন লিখেছেন, সম্প্রতি মার্কিন এবং চীনের প্রযুক্তিগত সংস্থাগুলোর মধ্যে যে নতুন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে; সেখানে নতুন সংজ্ঞা আরোপ করতে চান ট্রাম্প। নিজের ঘরে বসেই চীনকে বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি তাই এই নয়া মিশন শুরু করেছেন তিনি। অর্থাৎ অ্যাপের জনপ্রিয়তাকে হাতিয়ার করেই নিজ সংস্থার হাতে ক্ষমতা চাইছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। তবে নভেম্বরে যদি আসনচ্যুত হন ট্রাম্প, আর তার জায়গায় ক্ষমতায় আসেন ডেমোক্র্যাটের জো বাইডেন, তাহলে কি পরিস্থিতি একই থাকবে? না কি চীনা অ্যাপের বিরুদ্ধে সুর নরম করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপরদিকে মুসলিম দুনিয়ার রাজনীতিবিদ, শাসক গোষ্ঠী বা ধর্মীয় নেতারা সুযোগ পেলেই এই শব্দটা অহরহ ব্যবহার করে আর ‘উম্মাহ’র একতার কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। কিন্তু গত ১৪০০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে কোন কালে বা কোন অঞ্চলে এমন একতার তেমন কোনো উদাহরণ পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলমান মুসলমান মারামারি কাটাকাটি আর যুদ্ধ করে যত মুসলমানের মৃত্যু হয়েছে; তা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত ওসমানীয় (ওটোমান) সাম্রাজ্য পরবর্তী ৭০০ বছর উত্তর আফ্রিকা হতে শুরু করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত একটি বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছিল। বিশ্বের ইতিহাসে আর কোনো সাম্রাজ্য এত বড় আর দীর্ঘ সময় ধরে শাসন করেনি। ওসমানিয়া শাসনের কেন্দ্রস্থল ছিল বর্তমান ইস্তাম্বুল।

কিন্তু তাদের এই একতা সহ্য হয় না পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর, বিশেষ করে ইংরেজ আর ফরাসিদের। শুরু হয় এই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সূত্রপাত হয় ইংরেজ ও ফরাসিদের প্ররোচনায় বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহ। এমন একটি ষড়যন্ত্রের ফসল সৌদি আরবের মতো একটি চরম মৌলবাদী দেশের গোড়াপত্তন হয় ১৯৩২ সালে। এটি বিশ্বের একমাত্র দেশ, যার নামকরণ একটি পরিবারের নামানুসারে, ইবনে সৌদ পরিবার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অনেকটা সাম্রাজ্য বাঁচানোর উদ্দেশ্যে ওটোমানরা ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে জার্মানদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হলে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি পুরো ওসমানীয় সাম্রাজ্য দখলে নেয়। অনেকটা কামাল আতাতুর্কের প্রজ্ঞা ও কৌশলের বলে তুরস্ককে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। কয়েক দিন আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি হয়; যার অর্থ একে অপরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে, অনেকটা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার মতো। তাদের সঙ্গে আগের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল এখন শুধু তা আনুষ্ঠানিক হয়েছে। সপ্তাহ না ঘুরতেই ইসরায়েল হতে সৌদি আরবের আকাশসীমার ওপর দিয়ে আবুধাবিতে উড়ে এলো প্লেনভর্তি মার্কিন সিনেটর, কংগ্রেসম্যান আর ইসরায়েলের রাজনৈতিক নেতারা। সৌদি আরব ঘোষণা দিয়েছে, এখন হতে ইসরায়েলের জন্য তাদের আকাশসীমা উন্মুক্ত। এর আগে ইসরায়েলের নির্বাচনে নেতানিয়াহুর বিজয় নিশ্চিত করতে সৌদি আরব অর্থ ঢেলেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সৌদি আরব তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ কখনো অস্বীকার করেনি। সৌদি আরবকে অনেক মুসলিম দুনিয়া মুরব্বি মনে করে।

মুসলমান প্রধান দেশসমূহের সংগঠন ওআইসির মোট সদস্য দেশের সংখ্যা ৫৭টি; যাদের মধ্যে মাত্র চারটি দেশ নিজেদের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছে। এরা হচ্ছে পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান আর মৌরিতানিয়া। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল ওমর জাবেদ বাজওয়া ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান জেনারেল ফয়েজ হামিদ কয়েক সপ্তাহ আগে গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। উদ্দেশ্য সৌদি বাদশাহকে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করা। দেখা না করে বাদশাহ বলে পাঠালেন এসব শোনার তার সময় নেই। এগুলো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

সৌদি আরবের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পাকিস্তানের চেয়ে সব সময় ভালো। হতাশ হয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি ছুটলেন চীনে। যে চীন বছর বছর ধরে তাদের উইঘুর প্রদেশে কয়েক লাখ মুসলমানের ওপর চরম নির্যাতন চালাচ্ছে, তারা কেন কাশ্মীর নিয়ে মাথা ঘামাবে? উইঘুর বিষয়ে কোনো মুসলিম দেশকে তো দেখা যায় না টুঁ শব্দটি করতে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চাইছেন তুরস্ক, মালয়েশিয়া আর পাকিস্তানকে নিয়ে সৌদিবলয়ের বাইরে মুসলিম দুনিয়ার আর একটি মোড়ল গোষ্ঠী সৃষ্টি করতে। এখন পর্যন্ত ইমরান খান তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এদিকে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করল বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে। সেই বাংলাদেশকে সৌদি আরব স্বীকৃতি দিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর। সৌদি আরব বর্তমানে আমেরিকার হয়ে প্রতিবেশী মুসলমান প্রধান দেশ ইয়েমেনের ওপর নিয়মিত বোমা ফেলে নিরীহ মানুষ হত্যা করে। এ পর্যন্ত ওআইসিভুক্ত কোনো দেশ সে সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি।

এ ছাড়া ভারতের কাশ্মীর নিয়ে বাংলাদেশের কিছু মহল ছাড়া আর কারো তেমন মাথাব্যথা নেই। মিয়ানমার তাদের এথনিক ক্লিনজিং-এর অংশ হিসেবে আরাকান রাজ্য হতে রোহিঙ্গা মুসলমান উৎখাত করা শুরু করল। রাতারাতি বাংলাদেশে ১০ লাখ ঢুকে পড়ল। এখন তারা বংশবৃদ্ধি করে প্রায় বারো লাখ। কয়েক হাজার গেল মায়লেশিয়া আর থাইল্যান্ডে। কিছু ভারতে গিয়েছিল। থাকতে পারেনি। মিয়ানমারের এই অমানবিক কর্মকান্ড নিয়ে কোনো মুসলিম দেশের তেমন কোনো উচ্চবাচ্য তো শোনা যায় না। তাদের দেখতে বাংলাদেশে এলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের স্ত্রী। চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। রোহিঙ্গা শরাণার্থী শিবিরে গিয়ে কিছু ফটোশেসন হলো। তারপর সব শেষ। বর্তমান সময়ের জটিল ভূরাজনীতি পর্যালোচনা করলে এটি পরিষ্কার মুসলিম উম্মাহ বলতে বাস্তবে কিছু নেই। ওআইসিভুক্ত ৫৭ দেশ অভিন্ন কণ্ঠে কোনো বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবে না। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ক সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। রোহিঙ্গাদের অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হবে, তা মনে হয় না। সুতরাং এটি নিশ্চিত বলা যায়, একদিকে লক্ষ কোটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যে আক্রান্ত দিশাহারা মানুষ আর অন্যদিকে গ্রিনরুমের করপোরেট প্রভুরা। মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে কিংবা বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করার জন্য, বর্তমান স্তাবকদের ছুড়ে ফেলে, তৈরি করবে নতুন সহযোগী। যেহেতু মানুষ ঐক্যবদ্ধ নয়, তা হওয়া সম্ভবও নয় কিংবা পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো শক্তিধর মানবিক রাষ্ট্রও নেই, তাই দাবার গুঁটিতে পরিণত হতে হবে মানুষকে। হয়তো উন্মেষ হবে নতুন এক পৃথিবীর, যার রাজনৈতিক চিত্র তো বটেই, ভৌগোলিক চিত্রও পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।

করোনা সংকট থেকে বেঁচে গেলে সেটি হয়তো দেখা যাবে, না হয় যারা বেঁচে থাকবে তারাই দেখবে। এ বাস্তবতা এবং পৃথিবীর ইতিপূর্বের সব দুর্যোগ, মহামারি পরবর্তী কাল, অর্থনৈতিক মহামন্দা ইত্যাদি বিবেচনায় বলা যায়, পৃথিবীর ভূরাজনীতিতে একটি নতুন খেলা শুরু হবে। চীন-ভারত লাদাখ সীমান্তে ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে। আমেরিকা পারস্য উপসাগরে নিজেদের রণতরীগুলোর ১০০ মিটারের কাছাকাছি যেকোনো ইরানি নৌযান ধ্বংসের সরাসরি নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। ইরানের পাল্টা হুমকি চলমান আছে। হঠাৎ কী এমন হলো যে, ইতোমধ্যে প্রতিবেশী নেপাল, শক্তিধর ভারতের বিরুদ্ধে কঠিন হুংকার দিয়েছে, এমনকি তাদের মানচিত্রে বর্তমান ভারতের অংশবিশেষ চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতালিসহ কয়েকটি দেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয় বিবেচনা করছে। তেল নিয়ে আমেরিকা তার প্রিয় বন্ধু সৌদি আরবকে সরাসরি হুমকি দিয়েছে। আজ হোক, কাল হোক নতুন তৃতীয় বিশ্বযুদ্বের সূচনা হতে পারে। শুরুটা হবে রাষ্ট্রনায়করা যখন তাদের পিঠ বাঁচাতে চাইবে আর এ খেলায় কোচ হবে করপোরেট জগতের প্রভুরা। পুঁজিবাদের ধর্ম অনুযায়ী নতুন জায়গা বা বাজার তৈরি করতে হলে শূন্যস্থান তৈরি করা দরকার, সেটি যুদ্ধের মাধ্যমে হোক কিংবা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে হোক, বাজার টিকে থাকতে হবে। তাতে যদি পৃথিবীতে ব্যাপক প্রাণহানিও হয় অসুবিধা নেই। পুঁজিবাদ তো থাকবে। এদের প্রতিহত করার কোনো শক্তিও কারো নেই, কারণ কম বেশি সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এদের হাতে জিম্মি কিংবা এদের কারণেই ক্ষমতায় এসেছেন। দেশে বিদেশে করপোরেট প্রভুরা এখন সব ক্ষমতার মালিক। একসময় কেটে যাবে এই দুঃসময়। কিন্তু এরমধ্য দিয়ে গোপনে বিশ্বরাজনীতির যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, সেটা সময়ই আরো স্পষ্ট করে দেবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close