reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

বিশ্লেষণ

পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন অসম্ভব না

নিতাই চন্দ্র রায়

পেঁয়াজ নিয়ে দেশে গতবারের মতো তুঘলকি কান্ড ঘটুক এটা জনগণের কাছে মোটেও প্রত্যাশিত নয়। এমনিতেই বন্যার কারণে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, সবজি, আলু, ডিম, আদা, রসুন ও কাঁচামরিচের দাম অনেক বেড়ে গেছে। করোনায় কাজ হারিয়ে মানুষের আয়-উপার্জন একেবারে কমে গেছে। স্বল্প আয়ের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে, ঠিক এ সময়ে পেঁয়াজের মতো একটি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং গত বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ভারতের রফতানি বন্ধের খবরে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের পেঁয়াজের বাজার। আজ থেকে এক মাস আগেও দেশে পেঁয়াজের বাজার এত অশান্ত ছিল না। তখন প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর ভারতীয় আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা। আর ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এতে স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষ পড়েছে মহাবিপদে।

গত বছর ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে ন্যূনতম মূল্য ৮৫০ ডলার বেঁধে দেয়। এর ১৬ দিন পর ৩০ সেপ্টেম্বর পণ্যটির রফতানি সব দেশের জন্যই একবারে বন্ধ করে দেয় ভারত। এতে বেশি সংকটের সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে। কারণ, বাংলাদেশে আমদানিকৃত পেঁয়াজের সিংহভাগ আসে ভারত থেকে। গত বছর ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের কারণে সেপ্টেম্বর মাসে পেঁয়াজের দাম এক লাফে ১০০ টাকা, অক্টোবরে ২০০ এবং নভেম্বরে তা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজিতে পৌঁছায়। বিদেশ থেকে বিমানে করে পেঁয়াজ আমদানি করেও দেশে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে রাখা যায়নি।

সম্প্রতি (০৯.৯.২০২০) বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশিন (বিটিটিসি) পেঁয়াজের বাজার ও আমদানি পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। তাতে বলা হয়, দেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টন। কিন্তু বাস্তবে দেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ৩০ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসরাণ অধিদফতরের হিসাবে গত বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন এবং এ বছর দেশে পণ্যটি উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। উত্তোলন পরবর্তী সংরক্ষণজনিত ক্ষতি শতকরা ২৪ ভাগ দিলে প্রকৃত উৎপাদন দাঁড়ায় ১৯ লাখ টন। দেশে বর্তমানে পেঁয়াজের মজুদ রয়েছে সোয়া পাঁচ লাখ টনের মতো। সেই হিসেবে আরো পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে ছয় লাখ টন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে দেশে ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। গত বছর একই সময়ে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছিল পৌনে ৭ লাখ টন।

ট্যারিফ কমিশনের কর্মকর্তারা সম্প্রতি দেশের কয়েকটি পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যে প্রতিবেদন প্রদান করেন, তাতে ভারতের বাইরে অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুপারিশ করা হয়। ভারতের বিকল্প দেশগুলো হলো মিয়ানমার, মিসর, তুরস্ক, চীন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেদারল্যান্ডস ও মালয়েশিয়া। ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন আমাদের ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম থেকে এ পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৯১৩ টন পেঁয়াজ আমদানি করার জন্য অনুমোদন নিয়েছেন দেশের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা। এসব পেঁয়াজ মিয়ানমার, চীন, মিসর, পাকিস্তান, তুরস্ক ও নেদারল্যান্ডস থেকে আমদানি করা হবে। দেশে পেঁয়াজের বাজার হঠাৎ অস্থির হয়ে ওঠায় ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে অনলাইনে সুলভ মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রির কথা চিন্তা করছে টিসিবি। টিসিবি সাধারণত বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার টন পেঁয়াজ বিক্রি করে থাকে। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য এ বছর টিসিবির মাধ্যমে সারা দেশে এক লাখ টন পেঁয়াজ বিতরণ করা হবে।

পৃথিবীতে বছরে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত মোট পেঁয়াজের শতকরা ৬৫ ভাগ উৎপাদিত হয় ৮ দেশে। দেশগুলো হলো চীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, রাশিয়া, তুরস্ক, মিসর ও পাকিস্তান। বছরের ২ থেকে সোয়া ২ কোটি টন পেঁয়াজ উৎপাদন করে চীন। বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে। বছরে ১ কোটি ৯০ লাখ থেকে ২ কোটি টন উৎপাদন করে ভারত রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। অপরদিকে বছরে ৩২ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয়, ২৪ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করে ইরান চতুর্থ স্থানে রয়েছে। পেঁয়াজ আমদানির অসুবিধা হলো এটি অত্যন্ত পচনশীল একটি পণ্য। দূরবর্তী দেশ থেকে আমদানি করতে গেলে পথিমধ্যে পচে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং পরিবহন খরচও লাগে বেশি। তাই ব্যবসায়ীরা নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেই পণ্যটি আমদানির ওপর জোর দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া চীন, মিসর, পাকিস্তান ও ইরানে উৎপাদিত পেঁয়াজের আকার অত্যন্ত বড়। ঝাঁজ কম। ওইসব পেঁয়াজের দেশীয় বাজারে চাহিদা ও দাম কম। ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় শীর্ষ পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ। বছরে প্রায় ২ কোটি টন পেয়াজ উৎপন্ন হয় দেশটিতে। ২০১৮ সালে ভারত ১৯ লাখ ৯০ হাজার টন পেঁয়াজ রফতানি করে। বৈশ্বিক পেঁয়াজ রফতানির প্রায় ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে ভারত। ভারতে বছরে দুবার পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। একবার শীতকালে আর একবার গ্রীষ্মকালে। কোনো কারণে ভারতে পেঁয়াজের উৎপাদন বেশি হলে বাংলাদেশে পণ্যটির দাম কমে যায়। কৃষক উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করে পরের বছর পণ্যটির আবাদ কমিয়ে দেন। আবার ভারতে বন্যা বা অন্য কোনো কারণে পেঁয়াজের উৎপাদন হ্রাস পেলে ভারত সরকার হুট করে পণ্যটির রফতানি বন্ধ করে দেয়। ফলে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটি হলো একটি মৌলিক সমস্যা।

ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউশন ২০১৪ সালে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদন, বাজার ও অর্থনীতি নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এতে বলা হয়, ন্যায্য দাম পেলে পরের বছর কৃষক বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন করেন। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ। সঠিক উদ্যোগ গ্রহণের ফলে গত এক বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার টন। বিশ্বে হেক্টরপ্রতি গড় পেঁয়াজ উৎপাদন ১৮ টন আর বাংলাদেশে তা ১১ টন। তবে আশার কথা হলো, গত চার বছরে দেশে হেক্টরপ্রতি পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে তিন টন। এধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব। এজন্য নিম্নবর্ণিত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং কর্মকৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন।

১. পেঁয়াজ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে তার প্রয়োজনীয় পেঁয়াজ দেশেই উৎপাদন করতে হবে। এজন্য পেঁয়াজ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বাড়াতে হবে। গুণগত মানের বীজের ব্যবহার করতে হবে। কারণ, দেশে পেঁয়াজ চাষের জন্য যে বীজ ব্যবহার করা হয় তার সিংহভাগই কৃষক নিজেরাই উৎপাদন করেন। এসব বীজের গুণগত মান তেমন উন্নত নয় এবং ফলনও কম। ২. পেঁয়াজ চাষকে শুধু শীতকালে সীমাবদ্ধ না রেখে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালেও চাষের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য যেসব কৃষক গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে পেঁয়াজ উৎপাদন করবেন, তাদের বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সরকারিভাবে সহায়তা করতে করতে হবে। এ কাজে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি পেঁয়াজ-২, বারি পেঁয়াজ-৩ ও বারি পেঁয়াজ-৫ জাতগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। ৩. পেঁয়াজ চাষে শতকরা ৪ ভাগ সুদে কৃষিঋণ প্রদানের সরকারি সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ৪. আখ ও ভুট্টার সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে পেঁয়াজ চাষ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। ৫. দেশের প্রধান প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদন এলাকা বিশেষ করে ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী, নাটোর, যশোরে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ওয়ার হাউস বা সংরক্ষণাগার নির্মাণ করতে হবে, যেখানে কৃষক বা ব্যবসায়ীগণ আলুর মতো নির্দিষ্ট ভাড়ায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের সুযোগ পান। ৬. এ ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার মতো কৃষক পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণের প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহারে কৃষক উদ্বুদ্ধকরণে প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। ৭. দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য উৎপাদন মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ অব্যাহত রাখতে হবে। ৮. বন্যায় পেঁয়াজ চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেই সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ভারতে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজারে। তাই প্রতি বছর দেশে কী পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় এবং কী পরিমাণ প্রয়োজন, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে জুলাই মাসের মধ্যেই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পণ্যটি আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৯. পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আপৎকালীন সারা দেশে টিসিবি কর্তৃক সুলভ মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রির কার্যক্রম আরো জোরদার ও গতিশীল করতে হবে। ১০. পেঁয়াজ আমদানি এবং বাজারমূল্য নিয়মিত মূল্যায়ন করে অসৎ ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রাখতে হবে। ১১. পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের ওপর অতি নির্ভরশীলতা হ্রাস করে বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close