জি. কে. সাদিক
পর্যালোচনা
দেশপ্রেম এবং দেশপ্রেম...
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর শুধু আমি না আমার মতো অনেকেই হয়তো একজন দেশপ্রেমিক নেতা, বৃদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মীর সন্ধান করছেন। তাদের সঙ্গে আমিও একজন দলভুক্ত বৈ কিছু না। কথাগুলো বলছি বিশেষ কারণে। এক চেতনাবাদী আরেক চেতনাবাদীর দিকে আঙুল তুলছে। একদল অন্য দলকে দেশের শত্রু বলছে। ডানপন্থিরা বামদের বলছে অন্য দেশের আদর্শবাদী। বামরা পাল্টা খিস্তি দিচ্ছে ডানপন্থিদের সাম্প্রদায়িক বলে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিত্য ঘটনা। মাঝেমধ্যে টেলিভিশনে টক শো দেখে মনে হয় চায়ের দোকানের চাপাবাজি দেখছি। রাজনৈতিক নেতাদের জনসভা, আলোচনাসভা আর যত ধরনের সভা আছে সব সভার ‘মোরাল অব দ্য স্টোরি’ হচ্ছে বিরোধী দলের ওপর অপবাদ আর উসকানিমূলক বক্তব্য। অবস্থাদৃষ্টে সব সভাকে এক কথায় প্রকাশ করলে যা পাওয়া যায় তা হলো ‘সহিংতাসভা’ বা ‘বিষোদ্গারসভা’। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা পরস্পরের প্রতি বিদ্ধেষমূলক যে বক্তব্য দেন এর মাধ্যমে তারা নিজেদের জন্য দুটি উপাধি ধার্য করেন। একপক্ষ যখন অন্যপক্ষকে চোর-বাটপার, মিথ্যুক, প্রতারক, সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী বলে বাদ-অপবাদের লম্বা ফিরিস্তি দেন। অবচেতন মনে এ উপাধিগুলো তারা নিজেদের জন্যও ধার্য করেন। কারণ একপক্ষ যখন অন্যপক্ষকে চোর-বাটপার, মিথ্যুক-প্রতারক, সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী বলে অবহিত করেন তখন এখানে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়। যদি প্রতিপক্ষ উল্লিখিত ‘লকব’র উপযুক্ত না হন তাহলে যে বলছে সে মিথ্যুক। আর এমন বক্তব্য শুনে প্রতিপক্ষ বসে থাকার পাত্র নন। তারাও মজার সমস্ত জোর লাগিয়ে গলা ফাটিয়ে প্রতিপক্ষের সমোচিত জবাবে শ্রাব্য-অশ্রাব্য ভাষায় আরো বাড়তি কিছু অপবাদ দেবে। যদি দুই পক্ষই সত্য হয় তাহলে আর বলার কিছু থাকে না, দুদল একই গুদামের আলু। এখানে দুটি বিষয় তা হলো, যেকোনো একপক্ষ সত্যবাদী আর একপক্ষ চোর-বাটপার। আর নয় তো একপক্ষ মিথ্যাবাদী, অন্যপক্ষ চোর-বাটপার। তাই প্রশ্ন জাগে চরিত্রবান স্বাচ্চা দেশপ্রেমিক নেতা কোথায়?
একটা ‘কমন ডায়ালগ’ আমাদের রাজনীতিতে ব্যবহার হয়, আর একটা সস্তা আবেগ। সেটা চেতনার কথিত আবেগের পসরা ছাড়া আমি আর বিশেষ কিছু মনে করতে পারি না। আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হলো আমরা ‘বকধার্মীকদের’ কবলে পড়েছি। যবে না এদের কাছ থেকে রেহাই পাই, তাবৎ এ দেশের মানুষের মুক্তি ‘ঘুমের ঘরের স্বপ্ন’ জাগ্রত কর্ম নয়। রাজনীতির মাঠের কমন ডায়ালগটা আমাদের সবার জানা। একদল রাজনৈতিক নেতা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলে ওঠে তারাই স্বাচ্চা দিলে দেশের সেবা করে, তারাই খাঁটি দেশপ্রেমিক। আর সব টাউট-বাটপার, দেশের স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আরো কত খিস্তি হয় তার বিবরণ দিতে গেলে লেখা শ্রাব্য-অশ্রাব্য ভাষায় পূর্ণ হয়ে যাবে। যার রুচিশীল পাঠকের পাঠোপযুক্ত থাকবে না। তবে আবেগটার উৎসটা ‘সহিহ’ আর বাদবাকি যা হয় সবই ‘পেটনীতির’ জন্য ভণিতা। মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনা কোনটা সেটাই তো ৪৬ বছর পরও দ্বান্দ্বিক। একজন বলে স্বপ্ন এই আর অন্যজন ঠিক তার উল্টো। তর্কবিতর্ক দেখে হয়তো আগামী প্রজন্ম এটাই ধরে নেবে, আমাদের স্বাধীনতার মূল স্বপ্ন অত্যাচরী, স্বৈরাচারী, পেটুক, শোষকশ্রেণিভুক্ত শাসকের হাতে নির্যাতিত ও পৃষ্ঠ হয়ে বিলীন হয়ে গেছে। এখন আর স্বপ্ন বলে কিছু নাই।
দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৬ বছর আগে। কিন্তু অতি চেতনাবাদী ও অতীতধারী একদল এখনো কথায় কথায় ‘পাকিস্তান নিপাত যাক’ সেøাগানে মাঠঘাট কম্পিত করে তোলে। পাকিস্তান আর নিপাত কি যাবে? ৩০ লাখ মানুষ তো শহীদ হয়েছেই, ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম তো হারিয়েছেই। সেটা অতীত; সেটা আর ফেরানো যাবে না। কিন্তু তারা যে দেশের জন্য, যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রাণ দিয়েছেন সে দেশ আছে, আছে স্বপ্ন বাস্তবায়নের সমস্ত উপকরণ। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেউ পারেনি সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কোনো সুপরিকল্পনা বা ‘মাস্টারপ্ল্যান’ দিতে। অতীতের গর্ভে বর্তমানের জন্ম। অতীতধারী এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ‘মাড়ির দাঁত’ দিয়ে কামড়িয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে অতীতকে এখনো ধরে আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র চার বছরের মাথায় দেশ পথ হারাল। সেনাশাসন-স্বৈরশাসন শুরু হলো। কাক্সিক্ষত মুক্তি পেতে আবার প্রায় ১৫ বছর লেগে গেল। আবার ক্রমে মাথায় জগদ্বল পাথরের মতো সহিংসতা ও অপশাসন চেপে বসল। উত্থান-পতন আবার পুনঃগণতন্ত্র ফিরে পাওয়া এই সময়ের মধ্যে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কি এমন কর্ম দেখাতে পারবে, যা দ্বারা ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন’ বাস্তবায়নের পথে হাঁটা যাবে। যেদিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা ধরাতেই সময় পার। ইতিহাস পাঠে জানতে পারি পাকিস্তান আমলে ‘প্রেস স্ট্রাট’ ছিল স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পকেট পোষা বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকদের জন্য। এরা এমন কোনো কাজ করত না, যা দেশ ও জাতির কাজে লাগে।
এটা সোভিয়েত রাশিয়া নয়। রাশিয়ার উন্নয়নের সূত্র আমাদের দেশে একই কায়দায় প্রয়োগ করলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা জোরালো। পশ্চিমাদের সংস্কৃতি আর আমাদের সংস্কৃতি এক নয়। তাদের পারিবারিক কাঠামো, শিক্ষাপদ্ধতি, সংস্কৃতি তাদের সূত্র মতে আমাদের দেশে প্রয়োগ করা যাবে না। ‘আমিত্ব’ হারালে আমরা আবার পরাধীন হয়ে যাব। মানচিত্র-সর্বস্ব স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। তুরস্ক বা মিসরের ইসলামপন্থি দলের সূত্র বাংলাদেশে প্রয়োগ করলে আমাদের অস্তিত্বহানি ঘটবে। আমাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, যা হাজার বছরের পুরোনো। তাই আমাদের ভাবতে হবে এই দেশের সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক বিষয় নিয়ে আর জনগণ কেমন চায় তাদের প্রত্যাশার আলোকে। কোনো দলীয় ফরমূলায় দেশের উন্নয়ন নাও হতে পারে। কারণ সে দলের গ্রহণযোগ্যতা একটা বড় ‘ফ্যাক্ট’। যারা কমিউনিস্ট তারা কি দেশের সবার কাছে তাদের উন্নয়নপদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা পাবে? ইসলামপন্থি দলগুলোও কি অনুরূপ সমর্থন আদায়ে বা তাদের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে পারবে? এ দেশের মানুষ ধর্মকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করবে না। আর ‘শাসনী নৈতিকতা’র চেয়ে ধর্মীয় নৈতিকতা মানুষকে অপরাধ থেকে বিরত রাখতে বেশি কার্যকর। আবার ধর্মের নামে গোড়ামি আমাদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে। অতএব, দুটা থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। দেশের সংস্কৃতি, শিক্ষার, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হবে জনমনের প্রত্যাশার আলোকে ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়। আর এখানেই চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। তারা জনগণের সম্পত্তি হওয়ার চেঢে শাসকশ্রেণির আস্থাভাজন হতে ব্যতিব্যস্ত। কারণ জনগণ ক্ষমতা, অর্থ দিতে পারে না। শাসকশ্রেণি ক্ষমতা, অর্থ আর বিশেষ করে ‘আর্টিফিসিয়াল’ ও একপক্ষীয় সম্মানের ‘ডিব্বা’ দিতে পারে।
বড় বিপজ্জনক মানব শ্রেণি হলো বুদ্ধিজীবীরা। এদের রূপ চেনা কষ্টকর। আজ এটা বিশ্বাস করছে তো কাল ঠিক উল্টো। স্বার্থের দলনে পড়ে নিজেকেও বিক্রি করে দেবে। আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বইটা পাঠককে খুব করে পড়ার আবদার জানাচ্ছি। এরা স্বৈরাচারীকেও ক্ষমতায় রাখতে যেমন পর্দার আড়ালের ক্রীড়ানক, তেমনি পতনেও। তাই বুদ্ধিজীবীরা যখন বিবেক বিক্রি করে সে দেশ থেকে সুশাসন ‘বিদায়ী সালাম’ লয়। বিবেক যেমন একটা মানুষকে পরিচালিত করে, তেমনি বুদ্ধিজীবীরা একটি জাতিকে পরিচালিত করে। তাদের একটা বক্তব্য বা লেখনীই জাতির আমূল পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট। যে দেশের বুদ্ধিজীবীরা জনতারকণ্ঠ হয় সে দেশে জনগণের সরকার ও শাসন বৈ স্বৈরাচারী রাজত্ব করতে পারে না। বর্তমানে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশকেই স্বৈরশাসনের পক্ষে কথা বলতে শোনা যাচ্ছে। যদি তারা সত্যবাদী হন তাহলে আমি এটা বলি যে, এর জন্য মূলত দায়ী বুদ্ধিজীবীরাই। কারণ সর্বজন-স্বীকৃত স্বৈরশাসক এরশাদের সময়ও একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী তার আজ্ঞাবহ ছিল।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের পর থেকে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন প্রায় সম্পূর্ণটাই জীবন বিচ্ছিন্ন। এরাও দলীয় আজ্ঞাবহ। কারণ এদের উদ্দেশ্য নিরেট দর্শক হাসানো। সম্প্রতি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অশ্লীলতাই হচ্ছে মূল উপাদান। জাতীয় জীবনের সংকটের কোনো একটা বিষয় আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রতিফলিত হচ্ছে বা এ নিয়ে তাদের কোনো কর্ম আছে? আমাদের জোর হলো থুতনিতে। নিজের অপারগতার সমস্ত দায়ভার অন্যের কাঁধে চাপিয়ে শান্তিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। প্রতিপক্ষের জন্য উন্নয়ন করতে না পারার কথাটা আমাদের উন্নয়নের রূপকারদের মুখের নিত্যবাণী। ‘আমাদের জাতীয় মূলধন হতাশা’ সেটাই আরো প্রকট হচ্ছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"