reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৫ আগস্ট, ২০২১

শিক্ষার্থীদের হতাশা ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে চিকিৎসকদের ভাবনা

থমকে যাওয়া শিক্ষাজীবন, অনিশ্চিত ক্যারিয়ার ও স্বপ্নগুলোর রং বদলে যাওয়ার দৃশ্য মানতে না পেরে শিক্ষার্থীরা চরম মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। আজ হোক বা কাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঠিকই খুলবে। কিন্তু এসব শিক্ষার্থী কি ফিরতে পারবে তাদের স্বাভাবিক জীবনধারায়? নাকি ভবিষ্যতেও পড়বে এর ভয়ংকর প্রভাব! নেট আসক্তি, একাকিত্ব, একগুঁয়েমি, নড়বড়ে স্বপ্ন আর হতাশার পাহাড় নিয়ে আদৌ কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে মেরুদণ্ড মচকে যাওয়া শিক্ষার্থীরা? আগামীর প্রজন্মের এমন সংকটাপন্ন পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবছেন দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসকরা? শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন জবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নাঈমা আক্তার রিতা

দীর্ঘমেয়াদে সাইকোলজিক্যাল সমস্যায় নিমজ্জিত হবে

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলাকালে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট রুটিন করে চলে। কিন্তু এই মহামারি পরিস্থিতিতে সবার দৈনিক রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। এতে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বাসায় থেকে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বিরত এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজেকে যাচাই করতে না পেরে অনেক আগ্রহী শিক্ষার্থী তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ। তাদের স্বপ্নগুলো একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। তাছাড়া বাসায় আবদ্ধ থাকতে থাকতে একগুঁয়েমি মনোভাব তৈরি হচ্ছে। বেশির ভাগ সময় ইলেকট্রনিক ডিভাইস হেডফোন ব্যবহারের ফলে কানে কম শোনা, চোখে কম দেখা ও মাথাব্যথার মতো সমস্যা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ মাত্রাতিরিক্ত অনলাইন ব্যবহার করে অন্ধকার জগতের দিকে হারিয়ে যাচ্ছে।

সর্বোপরি এমন প্রতিকূল পরিবেশে মানসিক, শারীরিক

ও নৈতিক অবক্ষয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা দিন দিন

হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে। আর এরূপ প্রতিকূল পরিবেশ চলমান থাকলে অনেক শিক্ষার্থী সাইকোলজিক্যাল সমস্যায় ভোগতে থাকবে। এতে

করে অদূর ভবিষ্যতে জাতি কোয়ালিটি সম্পন্ন মানুষ তৈরিতে ব্যর্থ হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে

শিক্ষার্থীদের উচিত ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলা, একক রুমে মোবাইল ফোন ব্যবহার পরিহার করা ও

পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ভালো লেখকদের বই পড়ায় অভ্যস্ত হওয়া। শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

ডা. মোস্তফা কামাল

এমবিবিএস

মেডিকেল অফিসার

কুমিল্লা মিশন হাসপাতাল

মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে

করোনায় দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর তিন ধরনের প্রভাব পড়ছে; সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক। পড়াশোনার উদ্দেশ্য কেবল পাঠ্যবই পড়া, মুখস্থ করা এবং পরীক্ষার খাতায় লিখে আসা নয়; বরং সামাজিকীকরণ, মানসিক বিকাশ, ম্যাচুরিটির মতো বিষয়গুলো গভীরভাবে সম্পৃক্ত। বর্তমানে ঘরবন্দি সময়টায় অনলাইন ক্লাস হলেও এসব বিষয়ের বিকাশ সম্ভব হচ্ছে না। অটোপাস, পড়াশোনায় স্থবিরতা, সেশনজট, চাকরি ও ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগছে শিক্ষার্থীরা। সামাজিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে। এ ছাড়াও টিউশন ও পার্টটাইম চাকরি করে চলা শিক্ষার্থীরা এখন ভয়ংকর অর্থনৈতিক চাপের মুখে রয়েছে। যার প্রভাবে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, খাওয়া দাওয়ায় অনীহা, নেট আসক্তি, একাকিত্ব, নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়া এমনকি আত্মহননের মতো জঘন্য পথও বেছে নিতে দ্বিধাবোধ করছে না শিক্ষার্থীরা, এতটাই বিকৃত মানসিকতার সৃষ্টি হচ্ছে। যার প্রভাব নিঃসন্দেহে অতি দ্রুত কেটে যাওয়ার নয়। এমন মানসিক অস্থিতিশীল অবস্থার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব পড়ে শারীরিক স্বাস্থ্যেও। যা দীর্ঘমেয়াদে ভোগান্তির কারণ হতে পারে।

শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে অতি দ্রুতই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলা জরুরি। তবে শুধু খোলার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমস্যার হবে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মানসিক বিকাশ ও পরিচর্যার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সর্বোপরি একটা সুস্থ মানসিক পরিবেশ তৈরি করে পড়াশোনার চাকা সচল করতে পারলে শিক্ষার্থীরা পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে বলে আমি করে করি। অন্যথায় জাতিকে এর জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে।

ডা. আফতাব হোসেন

চিকিৎসক, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, ইংল্যান্ড

অনেক বেশি দায়িত্বশীল ও নমনীয় হতে হবে

করোনা মহামারির কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ও মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ছোট শিক্ষার্থীরা গেমস, তরুণ শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট অপব্যবহারের মাধ্যমে সমাজ ও নৈতিকতাবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত হচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। তবে শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করে লাভ নেই। তারাও প্রচন্ড হতাশা ও একঘেয়েমির মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছে। সব মিলিয়ে ভবিষ্যতে দেশ এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে শিক্ষাবিদরা মনে করছেন। দেশ দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারবে না। ফলে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে। তার পরও আমি মনে করি, শিক্ষার্থীদের সুস্থ ও স্বাভাবিক রেখে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। এ দায় কারো একার নয়, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, স্থানীয় প্রশাসন, সমাজসেবক ও রাজনীতি বিদদের সার্বিক সহযোগিতায় তাদেরকে সার্বক্ষণিক মানসিক সমর্থন দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনার সন্তান আপনার কথা না মেনে না চললেই তারা তার প্রিয় শিক্ষকদের কথা ভালোমতো শুনবে। প্রয়োজনে প্রিয় শিক্ষকদের সহযোগিতা নিন। সরকারকে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিবেচনা করে তাদের বিষয়ে আরো সচেতন হবে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের চাকরি প্রবেশের বয়সীমা বাড়িয়ে দিতে হবে ও নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। তরুণ শিক্ষার্থীরা যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ছেলেমেয়েদের মানসিক সমস্যা দেখা দিলে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের সচেষ্ট থাকতে হবে। বর্তমান মহাসংকটে মহাউদ্যোগে সবাইকে এগিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে বাস্তব আশা পূরণের নিশ্চয়তা প্রদান করা আমাদের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য।

অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মাদ

মনোচিকিৎসক ও চেয়ারম্যান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

পিছিয়ে পড়াকে মেনে নিয়েই পথ চলতে হবে

ছাত্রছাত্রীদের চলমান সময়ে হতাশার মূল কারণ হচ্ছে প্রতিষ্ঠান খুলছে না, পড়াশোনার একচুয়াল গাইডলাইন পাচ্ছে না, পরীক্ষা হবে কী হবে না, জানতে পারছে না, যে কারণে তারা তাদের টার্গেট অ্যাচিভমেন্টের দিকে ফোকাস করতে পারছে না এবং তারা ভাবছে, অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। প্রচুর অবসর সময় হাতে পেয়ে মোবাইল, গেমসহ নানা বদ-অভ্যাসে জড়িয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রচন্ড রকম হতাশা এবং ডিপ্রেশনে ভুগছে। এই অবস্থা থেকে জাতির বিশাল একটি অংশকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে পারিবারিক সাপোর্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের মানসিকভাবে হেল্প করা, ঘরোয়াভাবে বিনোদনের ব্যবস্থা করা জরুরি, পাশাপাশি একটা নির্দিষ্ট সময় তাদের আশপাশে কোথাও ঘুরতে নেওয়া, সেটা অবশ্যই স্বাস্থ্য সচেতনভাবেই করতে হবে। আর যত দ্রুত সম্ভব করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই যেন স্কুল-কলেজ খুলে দেয়। যত দ্রুত তারা বিদ্যাপীঠে যেতে পারবে, তত দ্রুত তাদের হতাশা কেটে যাবে। তবে এর প্রভাব নিঃসন্দেহে অনেক দিন থাকবে। কিছুটা শূন্যস্থান অপূরণীয় হয়েই থাকবে।

ডা. মশিউর রহমান মজুমদার

এমবিবিএস, মেডিকেল অফিসার ভিশন হাসপাতাল

শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফেরানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে

কোভিড-১৯ মহামারি শিক্ষার্থীদের ওপর যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রাখবে, তা মোটামুটি স্পষ্ট। চিকিৎসক হিসেবে আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে দুই ধরনের শিক্ষার্থীদের পরিণতি কী হবে। একদিকে আছে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশু শিক্ষার্থীরা, অন্যদিকে আছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, যাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কোভিড মহামারির জন্য ব্যাহত হওয়া শিক্ষা কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় শিকার হবে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা। এরা শিক্ষাগ্রহণের জন্য প্রায় সম্পূর্ণরূপে শ্রেণিকক্ষ নির্ভরশীল। অনলাইন শিক্ষার সুযোগ অথবা সামর্থ্য এদের নেই। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান ব্যাহত হওয়ায়, এদের মধ্যে অনেকেই পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়বে, অনেককেই শিশুশ্রমে নিয়োজিত করা হবে (পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে)। মহামারি শেষে বাংলাদেশের এই বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে ফেরানো একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। অন্যদিকে যেসব শিক্ষার্থীর এত দিনে পাস করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার কথা, তাদের ক্যারিয়ার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কর্মজীবনে প্রবেশ না করতে পেরে আর্থিক সমস্যার মধ্যে আটকে আছে বহু ছেলেমেয়ে, অনেকেরই পরিবার হয়তো এদের উপার্জনের ওপরই নির্ভর করে ছিল। বিকল্প আয়ের পথও বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশ সীমিত। এই অনিশ্চয়তা শিক্ষার্থীদের মনোজগতে প্রচন্ড বিরূপ প্রভাব ফেলবে। অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঝুঁকে পড়বে মাদকদ্রব্যের প্রতি। এ কারণেই ইউনিসেফ শিক্ষার্থীদের যত দ্রুত সম্ভব শ্রেণিকক্ষে ফেরানোর ওপর জোর দিচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে কীভাবে শ্রেণিকক্ষভিত্তিক পাঠদান পুনরায় শুরু করা যায়।

ডা. মো. নাজমুস সাকিব

চিকিৎসক, ন্যাশনাল হেলথ্ সার্ভিস

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close