আরিফুল ইসলাম জিমন, ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর)

  ২৫ মার্চ, ২০২৪

ঘোড়াঘাট তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

অব্যবহৃত থেকে থেকে নষ্ট প্রশিক্ষণের যন্ত্র

নষ্ট হচ্ছে অর্ধকোটি টাকার যন্ত্রাংশ * চলতি মাসে কারখানার দুটি তাঁত মেশিন চালু করার উদ্যোগ

রাস্তার পাশ দিয়ে অনেক দূর থেকেও একসময় শোনা যেত তাঁত বুননের খটখট শব্দ। এখন তা নেই। এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে নির্মিত দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের বঙ্গবন্ধু তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কারখানাটি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। অকেজো হয়ে পড়ে আছে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি। জলে যাচ্ছে অর্ধকোটি টাকারও বেশি মূল্যের এই কারখানার যন্ত্রাংশ।

জানা গেছে, কারখানাটি ঘোড়াঘাট সরকারি কলেজ থেকে পূর্ব দিকে এবং ভূমি অফিস থেকে পশ্চিম দিকে একটু দূরে রাস্তার উত্তর পাশে উপজেলার ৩নং সিংড়া ইউপির আবিরের পাড়ার সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত। ঘোড়াঘাট সরকারি ওয়েবসাইটে বলা হয়, এ জাতীয় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান দেশে এটিই প্রথম। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের কীভাবে টেকসই উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করা যায়, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তাদের জন্য তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রস্তাবটি অনুমোদন ও বাস্তবায়নে বরাদ্দ প্রদান করা হলে ‘বঙ্গবন্ধু তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কারখানা’ স্থাপন করা হয় এবং প্রথম পর্যায়ে ২০টি তাঁত স্থাপন করা হয়, সেই সঙ্গে স্থানীয় সহযোগিতায় ১০টি তাঁতের কাচামাল ক্রয় করে প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন শুরু হয়।

জানা যায়, ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদের ব্যবস্থাপনা এবং উদ্যোগে তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের কাপড় বুনন প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করতে কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু পুঁজি ও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে বর্তমানে এই তাঁতশিল্পের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনও এ ব্যাপারে উদাসীন। ইউএনও অফিস সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৭ সালের মে মাসের ১৬ তারিখ ইউএনও হিসেবে ঘোড়াঘাট উপজেলায় যোগদান করেন টি এম এ মমিন। এরপর থেকেই তিনি উপজেলায় নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ ১০টি উদ্যোগের মধ্যে গ্রামীণ পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের কুঠির শিল্প প্রশিক্ষণে স্বাবলম্বী করার কাজকে এগিয়ে নিতে তাঁত প্রশিক্ষণের কার্যক্রম চালু করেন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রকল্প বরাদ্দ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের উন্নয়নে বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত) শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় ৫৯ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন বঙ্গবন্ধু তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কারখানা। যেখানে নরসিংদীর মাধবদী থেকে পুরোনো ২০টি তাঁত মেশিন আনা হয় এবং ১০টি তাঁতের কাচামাল ক্রয় করে প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন শুরু করানো হয়।

প্রথমে ১৬টি মেশিন চালু করা গেলেও ৪টি মেশিন অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ এনে ওই ৪টি মেশিন চালু করা হবে বলে বাকি মেশিনগুলো কাজে লাগানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি তাঁত মেশিন চালু হলে ঘোড়াঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় এখানকার তৈরি লুঙ্গি, গামছাসহ অন্যান্য কাপড়-চোপরের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। এরই অংশ হিসেবে উপজেলা সদর ওসমানপুর কারখানার একটি শো-রুমও উদ্বোধন করা হয়। যাতে করে সব জায়গা থেকে মানুষ ন্যায্যমূল্যে এখানকার তৈরি শাড়ি-লুঙ্গি ক্রয় করতে আসে (যেখানে কাঁচামাল ও শোরুম উদ্বোধনসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ মিলিয়ে দাঁড়ায় প্রায় আরো ১০ লাখ টাকা)। এই লক্ষ্যে সিরাজগঞ্জ থেকে দক্ষ প্রশিক্ষক আনা হয় এই কারখানায় এবং পাশাপাশি উন্নতমানের লুঙ্গিও প্রস্তুত করা হয়। অল্প দিনের মধ্যেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা চরকার মাধ্যমে মাক্কুতে সুতা তোলার কাজ শিখে কাজও শুরু করে। যেহেতু কারখানাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য স্থাপন করা হয়েছে, তাই কারখানা থেকে তৈরি করা পণ্যের ব্রান্ডিং নাম রাখা হয় ‘এথনিক’।

কারখানাটির পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করেন ‘ইউএনও’। উৎপাদিত পণ্য কারখানা ও শোরুমে পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় করা শুরু হয়। বিক্রয়মূল্য রাখা হয় প্রতি পিস লুঙ্গি ২৫০ থেকে ৮৫০ টাকার মধ্যে এবং গামছা প্রতি পিস ১১০ টাকার মধ্যে। 

গত ২০১৮ ইং সালের নভেম্বর মাসের ৭ তারিখ বদলিজনীত কারনে বিদায় নেন ইউএনও টিএমএ মমিন। এরপর ইউএনও ওয়াহিদা খানম একই দিনে ঘোড়াঘাটে যোগদানের পর ২০২০ইং সালের নভেম্বরের আগে পর্যন্ত প্রায় বছর দু-এক কারখানাটি ভালোই চলছিল। কিন্তু নভেম্বর মাসের ২ তারিখে ইউএনও ওয়াহিদা এক নৃশংস হামলার শিকার হন (সারা দেশে আলোচিত) এবং তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। এরপর ওই মাসের ২৩ তারিখে ইউএনও হিসেবে যোগদান করেন রাফিউল আলম। কিন্তু করোনা মহামারি এবং একের পর এক ইউএনও বদলির কারণে কারখানাটির কার্যক্রম ধীরগতিতে রূপ নেয়। কিছুদিন পরপরই ৩-৪টি করে তাঁত মেশিন বন্ধ হতে থাকে এবং একে একে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরাও কারখানায় আসা বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে একজন সহকারী প্রশিক্ষক ও একজন কেয়ারটেকার ছাড়া বাকিরা বেতন-ভাতার সমস্যায় অন্যত্র চলে গেছে। অন্যদিকে ২০টি তাঁত মেশিনের মধ্যে ১৮টি বিকল হয়ে পড়ে আছে। মাত্র দুটি তাঁত মেশিন কোনো রকমে খুঁড়িয়ে চললেও বর্তমানে পুঁজি ও যথাযথ তদারকির অভাবে বন্ধ প্রায় সম্ভাবনাময় এই কারখানাটি।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, কারখানায় অবশিষ্ট যে দুজন রয়েছে তাদের বেতন ভাতাও ৪-৫ মাস থেকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, যদিও শর্ত ছিল কারখানা চলুক বা না চলুক প্রশিক্ষক, সহকারী প্রশিক্ষক এবং কেয়ারটেকাররা প্রতি মাসের নির্ধারিত সময়ে বেতন পাবে। কিন্তু এখানে সে শর্তও ভঙ্গ হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা কারখানায় আসা বন্ধ করার কারণ জানতে গিয়ে পাওয়া যায় ভিন্ন রকম তথ্য। ইউএনও রাফিউল যোগদানের পর থেকে সাবু কেরানি নামের এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। যিনি নিজেকে সব ইউএনওর আত্মীয় বলে পরিচয় দিতেন। তিনি বেশির ভাগ সময় ইউএনও রাফিউল আলমের সঙ্গে কারখানায় আসা শুরু করে দেন এবং ইউএনওর অনুপস্থিতিতে নিজেই কারখানার তদারকি শুরু করে দেন। তিনি বলেন ইউএনও তার ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন। তারপর থেকেই শুরু হয় নানা রকম বিপত্তি। তিনি আস্তে আস্তে সবার বেতন-ভাতা নিজেই দিতে শুরু করেন। বেশির ভাগ সময় কারখানা থেকে প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার দূরে তার বাড়িতে গিয়ে কর্মচারীদের বেতন নিয়ে আসতে বলতেন। অন্যদিকে শর্তানুযায়ী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের কাপর উৎপাদনের লভ্যাংশের একটি অংশ দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি সেটিও বন্ধ করে দেন এবং মনমর্জি মতো কারখানা থেকে যাকে তাকে ছাঁটাই করে দেন। এমন অবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় একটা সময় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সব ছেলেমেয়ে কারখানায় আসা বন্ধ করে দেয়। এরকম অবস্থা চলতে থাকায় একজন সহ-প্রশিক্ষক ও একজন কেয়ারটেকার ছাড়া বাকি প্রশিক্ষক ও কারিগররাও অন্যত্র চলে যায়।

এখানে প্রশ্ন থেকে যায় কে এই সাবু কেরানি? যার জন্য কারখানাটির এই দুরবস্থা? তার উদ্দেশ্যই বা কী ছিল? তাকে স্থান দিয়েছিল কারা? স্থানীয় বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম, তপন কুমারসহ একাধিক ব্যক্তিরা জানান, সরকারিভাবে এত সুন্দর একটি কারখানা কেন যে বন্ধ হয়ে আছে তা আমরা জানি না। তবে এলাকায় এরকম একটি প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার। কারখানাটি আগের মতো আবারও চালু করার জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট উদাত্ত আহ্বান জানান তারা। কারখানার সহ-প্রশিক্ষক বেলাল মিয়া জানান, সাবু কেরানি নামের ওই ব্যক্তি এখানকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই কারখানার এই অধঃপতন। যদিও নতুন স্যার যোগদানের পর থেকে সে আর ভিড়তে পারছে না। কিন্তু কারখানা চালানোর মতো অবশিষ্ট আর কিছুই নেই। বর্তমানে আমি নিজেও ৪-৫ মাস থেকে বেতন পাই না। এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলাম কিন্তু এখন কিস্তি দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। পরিবারের বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে এত কষ্ট করে কীভাবে বেঁচে থাকব। অনেক ঋণে জর্জরিত হয়ে গেছি। এভাবে চলতে থাকলে আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথ বাকি থাকবে না।

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, আমি কারখানার বিষয়ে তেমন কিছু জানতাম না। যোগদানের পর থেকে উপজেলার সব বিষয়ে জানার চেষ্টা করছি। কারখানা থেকে আয়ের কোনো অবশিষ্ট ফান্ড আমি এসে পাইনি। এ মাসের মধ্যে আপাতত কারখানার ২টি তাঁত মেশিন চালু করব। পর্যায়ক্রমে অন্য তাঁত মেশিনগুলোও চালু করার চেষ্টা করব। উল্লেখ্য, এ উপজেলায় বসবাসকারী ৮টি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close