গাজী শাহাদত হোসেন ফিরোজী, সিরাজগঞ্জ

  ০৩ আগস্ট, ২০২২

তাড়াশে তাল সড়ক, মনোহর

সিরাজগঞ্জে তাড়াশের নিমগাছি-ভূঁইয়াগাঁতী প্রায় ১৭ কিলোমিটার পিচঢালা মসৃণ সড়কের দুপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তালগাছ। এই তালগাছের সারি যেকোনো মানুষের নজর কেড়ে নেয়। পথ চলতে যেকোনো পথচারী ভাবতেই পারেন ঐতিহাসিক চলনবিলের শস্যভা-ার খ্যাত তাড়াশ উপজেলার কালের সাক্ষী তালগাছগুলো তাকে অভিবাদনে স্বাগত জানাচ্ছে অথবা বিদায় জানাচ্ছে। তালগাছের নাম অনুসারে স্থানীয় জনসাধারণ তাল সড়ক বলে অভিহিত করে থাকেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তাড়াশের তাল সড়ক গড়ে ওঠার পেছনে এলাকার মানুষের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি অবদান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমানের। বর্ষায় এ সড়কটির ভাঙন এবং পরিবেশ রক্ষার কথা চিন্তা করে সড়কের দুপাশে তালগাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমান তাড়াশের মাধাইনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থাকাকালীন ১৯৭৫-৭৭ সালে তাড়াশ-নিমগাছি-ভূয়াগাঁতী ১৭ মিলোমিটার রাস্তার দুপাশে ১০ ফুট পর পর প্রায় ১৪ হাজার তালগাছ রোপণ করেন। এজন্য তরি ইউনিয়নের সীমানা ছাড়িয়েও তাড়াশের হাটে বাজারে চৌকিদার দিয়ে ঢোল সহরত করে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। স্কুলের ছেলেমেয়েরাও এ কাজে এগিয়ে আসে বলে জানা যায়। ৩০টি পানসি নৌকায় নাচণ্ডগানের উৎসবের মধ্যে দিয়ে ১৪ হাজার তালবীজ রোপণ করা হয়। সেই তালগাছের বয়স এখন ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে। আবার ব্যক্তি উদ্যোগে নতুন গাছ রোপণ করা হয়েছে। বৃক্ষপ্রেমী গাজী আবদুর রহমান ১৯৭৮ সালে বৃক্ষরোপণের জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পান।

তালপাতাও তালগাছের কাণ্ড দিয়ে গৃহস্থালি ও বাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিস তৈরি করা হয়। তাড়াশে এখনো মাটির ঘরের প্রচলন রয়েছে। তালগাছ চেরাই করে ঘরের ধরনা, পার, বাটাম তৈরি করা হয়। মাটির তৈরি দ্বিতল ঘরের পাটাতনও তৈরি করা হয় তালগাছের তক্তা দিয়ে। তাল গাছের পাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি দেওয়া হয়। এছাড়া এ অঞ্চলের মাটির ঘরগুলোতে শীতকালে গরম এবং গরমকালে ঠাণ্ডা অনুভূত হয়।

তালগাছের বয়স ৩-৪ বছর হলেই তালপাতা দিয়ে তালপাটি, পাখা, হাতব্যাগ, ঝুড়িব্যাগসহ নানা উপকরণ তৈরি করা হয়। তালগাছ থেকে পাওয়া যায় রসালো ফল। তালগাছের রয়েছে ঔষধি গুণ। সুস্বাদু অনেক খাবার তৈরি করা যায় তাল রস থেকে। গ্রীষ্মকালে কচি তালের শাঁস সবার কাছে প্রিয়।

সিরাজগঞ্জ নজরুল একাডেমির আজীবন সদস্য প্রদীপ সাহা তাড়াশে বেড়াতে এসে বলেন, জেলার অন্যতম সুন্দর উপজেলা তাড়াশ। এই অঞ্চলে প্রবেশপথে সারিবাঁধা তালগাছ যেমন স্বাগত জানায়, তেমনি বিভিন্ন পুরোনো স্থাপনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। সিরাজগঞ্জের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা তাড়াশে এখনো বিদ্যমান রয়েছে।

প্রভাষক সনাতন দাস বলেন, সারিবাঁধা তালগাছ তাড়াশকে ভিন্ন আঙ্গিকে পরিচিত করেছে। তাড়াশের গুণী ব্যক্তিত্ব, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমান এই তাল সড়কের গোড়াপত্তন করেছেন। যিনি ৭০-এর দশকে গ্রামীণ রাস্তায় বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার ডাক দিয়েছিলেন। অথচ পরিতাপের বিষয় সরকারিভাবে তালসড়ক অধিগ্রহণ করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। যার ফলে তালগাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

তালগাছ রোপণকারী সাবেক চেয়ারম্যন আ. রহমান বলেন, এই তাল সড়কের তালগাছগুলো আর আগের মতো নেই। অনেক তালগাছ মরে গেছে। তালগাছের সঙ্গে সঙ্গে আমার বয়স বেড়ে যাওয়ায় এগুলো আর পরিচর্যা করতে পারছি না। ১৯৯০ সালে তালগাছ লাগানো সড়ক জেলা পরিষদ অধিগ্রহণ করে। কিন্তু গাছগুলো দেখভাল করার ব্যবস্থা নেয়নি আজ পর্যন্ত। এর মধ্যে জেলা পরিষদ ৪৫টি গাছ নিলামে বিক্রিও করে দিয়েছে। এছাড়া, অনেক তালগাছ এলজিইডি কর্তৃক বিভিন্ন সময় কর্তন করা হয়েছে কিন্তু তার পরিবর্তে কোনো তালগাছ রোপণ করা হয়নি।

সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায় প্রতিটি রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে তালগাছ রোপণ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করলে একদিকে যেমন রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধন, সড়ক রক্ষাসহ বীর মুক্তিযোদ্ধার লালিত স্বপ্ন ‘প্রতিটি সড়কে তালগাছ রোপণ’ বাস্তবে রূপ লাভ করত বলে সচেতন মহল মনে করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close