সঞ্জয় সূত্রধর, শিবালয় (মানিকগঞ্জ)

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২১

নজরুল স্মৃতির সেই প্রাসাদ

বিদ্রোহ, প্রেম এবং সাম্যের বাণী নিয়ে এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং সামন্তবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তার সাহিত্যে নারী জাগরণ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাসহ অনেক লেখা স্থান পেয়েছে। তার বিদ্রোহী চেতনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক বিশাল অবদান রেখেছেন তিনি। সংগ্রাম ছাড়াতেই মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা জমিদার ব্যারিস্টার কিরণ শঙ্কর রায়ের বাড়িতে একাধিকবার আসা-যাওয়া করেছেন তিনি। তার স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিবালয় উপজেলার তেওতা জমিদারবাড়িটি।

নজরুলের সাহিত্যচর্চার প্রেরণা এবং প্রেমের উৎস কবির সহধর্মিণী আশুলতা সেনগুপ্ত দোলন বা দুলি। বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ও গীরিবালা দেবীর একমাত্র সন্তান আশা লতা সেনগুপ্ত ১৯০৮ সালে তেওতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এখানে তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

এদিকে নজরুল প্রমিলা স্মৃতিবিজড়িত ওই জমিদারবাড়ি, প্রমিলার জন্মস্থান এবং প্রমিলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তেওতা গ্রামে অবস্থিত। নজরুল প্রমিলার স্মৃতিবিজড়িত স্থানে তাদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতি বছর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়ে আসছে কয়েক বছর ধরে। শিবালয়ে নজরুল প্রমিলা ইনস্টিটিউট, নজরুল-প্রমিলা পরিষদ, নজরুল-প্রমিলা সাহিত্য সংসদ, প্রমিলা-নজরুল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ইত্যাদি নামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এসব সংগঠনের দাবি, তেওতায় প্রমিলা-নজরুল নামে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার মতো একই মর্যাদায় নজরুলের শ্বশুরবাড়িতে সরকারিভাবে নজরুল জন্মজয়ন্তী ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন, নজরুল কমপ্লেক্স নির্মাণ, শিবালয়-জাফরগঞ্জ সড়কটি নজরুল-প্রমিলা সড়ক নামকরণ, মানিকগঞ্জ শহরে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ নামকরণ, মানিকগঞ্জ শহরে তেজেন মিত্রের বাড়িতে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন (এই বাড়িতে কবি ১৯৩৮ সালে অবস্থান করেন), নজরুল প্রমিলার স্মৃতিবিজড়িত স্থান জাতীয় পর্যায়ে সংরক্ষণ এবং নজরুল-প্রমিলার ভাস্কর্য স্থাপন করা।

শিবালয় নজরুল-প্রমিলা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সভাপতি অজয় চক্রবর্তী বলেন, নজরুল ও তার স্ত্রী প্রমিলার স্মৃতিধন্য তেওতায় সরকারি উদ্যোগে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়ি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে নজরুল সাহিত্য যেমন বিকাশিত হবে, এমনি এ স্থানটি আকর্ষণীয় পযটন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠবে।

তেওতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের জানান, তেওতা জমিদারবাড়িটি সরকারীভাবে সংস্কারের বিশেষ প্রয়োজন।

গত বৃহস্পতিবার বিকালে উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তেওতা জমিদারবাড়ি ঘুরতে আসা ঘিওর উপজেলায় রাবিতা আক্তার, সেলিনা আক্তার, ফারজানা আক্তার ও সুমন শেখ জানান, তেওতা বেড়াতে এসে তারা অনেক আনন্দ পেয়েছেন। জমিদারবাড়ির অনেক কিছু দেখে অনেক ভালো লেগেছে। কিন্তু বাড়িটি সংস্কার করা হলে আরো অনেক ভালো লাগত। এটি সংস্কার প্রয়োজন।

ঢাকা প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক রাখি রায় বলেন, ‘আমরা তেওতা জমিদারবাড়িটি কিছুটা সংস্কার করেছি। আরো সংস্কার করা হবে।’ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বি এম রুহুল আমিন রিমন বলেন, এ বাড়িটি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর নিয়েছে।

পারিবারিক তথ্য থেকে জানা যায়, আশালতার বাবা বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরায় নায়েব পদে চাকরি করতেন। কাকা ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন ত্রিপুরায় কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর। ইন্দ্র কুমার চাকরি সূত্রে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে বাড়ি করে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। বসন্ত কুমারের পরিবার তেওতার বাড়িতে অবস্থান করতেন। হঠাৎ বসন্ত কুমারের মৃত্যুতে আশালতার মা অসহায় হয়ে পড়লে ইন্দ্র কুমার উদ্যোগী হয়ে আশালতা ও তার মা গীরিবালা দেবীকে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে নিয়ে যান।

কাজী নজরুল ইসলাম বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লায় বেড়াতে এলে ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে আশালতার সঙ্গে পরিচয় হয় তার। নজরুল এই আশালতার টানে পাঁচবার কুমিল্লায় এবং বিয়ের আগে তেওতায় আসেন একাধিকবার। শেষবার জেলমুক্ত হয়ে কুমিল্লায় এলে আশালতা ও নজরুলের প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। একপর্যায়ে কুমিল্লা ছেড়ে কলকাতায় চলে যান নজরুল। গীরিবালা দেবী সামাজিক চাপে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আশালতাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যান। ১৯২৪ সালে গীরিবালা দেবীর একান্ত ইচ্ছায় নজরুল ও আশালতার বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর নজরুল আশালতার নাম রাখেন ‘প্রমিলা দেবী’।

যমুনার পাড়ে পঞ্চানন সেন প্রতিষ্ঠিত তেওতা জমিদারবাড়ির পরবর্তী বংশধর কিরণ শঙ্কর রায় চৌধুরীও ছিলেন স্বাধিকার আন্দোলনের আর এক সৈনিক। পূর্ববাংলার বাঙালি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের যে কজন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ব্যারিস্টার কিরণ শঙ্কর তাদের অন্যতম। গান্ধীজি, নেতাজি, কিরণ শঙ্কর, নজরুল সবাই ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ বিতাড়নে একাট্টা ছিলেন। তাই নজরুল প্রমিলার টানে যেমন তেওতায় একাধিকবার এসেছেন, তেমন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের পথ ধরেও হয়তো তেওতার জমিদার কিরণ শঙ্কর রায় চৌধুরীর কাছাকাছি হয়েছেন। পরবর্তীতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার কিরণ শঙ্কর রায় চৌধুরী। এসব দিক দিয়ে ঐতিহ্যবাহী তেওতার জমিদারবাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close