কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

নাছিরের মনোনয়ন বঞ্চনা টক অব দ্য টাউন

মেয়র হিসেবে আ জ ম নাছির দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরীর বিলবোর্ড উচ্ছেদ, ডোর টু ডোর ময়লা-আবজর্না সংগ্রহ, নগরীর কিছু ওয়ার্ডে সৌন্দর্যবর্ধনসহ বেশকিছু ভালো কাজ করেছেন। এছাড়া দলের সাধারণ সম্পাদক তার জন্য অনুরোধ করেছেন এ সত্ত্বেও মেয়র নাছির মনোনয়ন পাননি। বিষয়টি নিয়ে এখনো চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আলোচনা-সমালোচনা চলছে তার প্রতি দলের হাইকমান্ড কেন এত ক্ষুব্ধ। এটা এখনো টক অব দ্য টাউন। তবে বেশিরভাগ নেতাকর্মীর বিশ্বাস, ‘নেত্রী সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেন না।’

মেয়র নাছিরের চেয়ে কম পরিচিত এবং ত্যাগী নেতা রেজাউল করিম চৌধুরীকে নেত্রী মনোনয়ন দিয়েছেন। কেন এবং কী কারণে নেত্রী এটা করেছেন তা শুধু তিনিই বলতে পারেন বলে অভিমত নেতাকর্মীদের।

দলের নেতারা জানায়, এবার চট্টগ্রামের প্রায় সব ক’জন মন্ত্রী, এমপি, সাবেক মন্ত্রী একজোট হয়ে মেয়র নাছিরের বিরোধিতা করেছেন। নেত্রীর কাছে তুলে ধরেছেন তার নেতিবাচক দিক। দলের সিনিয়র নেতাদের মতে, মেয়র নাছির অন্যদের বাদ দিয়ে নিজেই চট্টগ্রামের একক নেতা হওয়ার চেষ্টা করেছেন। মেয়র এবং নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কারণে তিনি চট্টগ্রামের অন্য নেতাদের পাত্তা দিতে চাননি। তিনি কোনো অনুষ্ঠানে কাউকে ডাকেন না। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সবাইকে ডেকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করে গেছেন, দলে গ্রুপিং আরো জোরদার করেছেন।

দলের সিনিয়র নেতারা দুজন ছাত্রলীগ নেতা হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ এবং ছাত্রলীগ নেতা সোহেলের পরিবার কেঁদে নেত্রীর কাছে সন্তান হত্যার বিচার চেয়েছেন। অথচ মেয়র ইচ্ছা করলে এ ঘটনাগুলো মোকাবিলা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি করেননি। ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের পরিবার থেকে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে ছেলে হত্যার বিচার চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভুক্তভোগীদের বিচার চাওয়ার আগেই মেয়র নিজেই সেটা সমাধান করতে পারতেন। এছাড়া সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর পতœীকে অপমান করে স্টেজ থেকে নামিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। এ কারণেই মহিউদ্দিন চৌধুরীর পতœী হাসিনা মহিউদ্দিন মেয়র নির্বাচনে অংশ নিতে ফরম নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত জমা না দিলেও তা প্রধানমন্ত্রীর নজর এড়ায়নি। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেশ বিরক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।

এছাড়া মহিউদ্দিন পুত্র নওফেলের সঙ্গেও নাছির দ্বন্দ্বে জড়ান বলেও দলের সিনিয়র নেতারা অভিযোগ করেছেন। গত ৫ বছর ধরে চট্টগ্রামে দল কিভাবে চলেছে তার একটি ফিরিস্তিও তুলে ধরা হয়। বন্দর কেন্দ্রিক একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও একজন সংসদ সদস্যও নাছিরের মনোনয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে সক্রিয় ছিলেন বলে জানা গেছে। নিজের ব্যবসার জন্য মেয়র বন্দরকে ব্যবহার করছেন বলেও তারা প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যে কারণে তার জন্য তাদের কাজ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের কাউন্সিলরদের মধ্যে অনেকে তার বিপক্ষে অবস্থান নেন। সিনিয়র মন্ত্রীদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে তারা এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, মেয়র নাছিরের পছন্দের কয়েকজনের দাপটে তাদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হয়নি। মেয়র হিসেবে তিনি প্রত্যেক ওয়ার্ডকে সমান নজরে দেখেননি। পছন্দের কাউন্সিলরদের প্রাধান্য দেওয়াটাও এক পর্যায়ে মেয়রের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।

মেয়রের মর্যাদা নিয়ে তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স’ মতে মেয়র পদটি রাষ্ট্রের ১৮ নম্বর সম্মান জনক পদ। যে কারণে চট্টগ্রামের মেয়রকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্ত তাকে দেওয়া হয়নি। কারণ মেয়র পদের পাশাপাশি এমন কিছু পদের দায়িত্বে তিনি থেকেছেন যা এমনকি ডিসির নিচেও। তিনি চট্টগ্রামের একটি হাউজিং সোসাইটির সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক (এখানে জেলা প্রশাসক সভাপতি), চট্টগ্রাম জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিসহ বেশকিছু সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এত পদে থেকে তিনি কিভাবে সিটি করপোরেশন এবং দলকে সময় দেবেন এ বিষয়টিও তুলে ধরা হয়।

নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও তার ওপর বিরক্ত ছিল বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প দিয়েছেন। সিডিএ’র মাধ্যমে সেনাবাহিনী এটি বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু স্থানীয় সরকারে নগরীর নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখার রুটিন কাজগুলো কেন করছে নাÑ এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় তাগাদা দেওয়া হলেও চসিক কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী চট্টগ্রামে এসে তাকে স্মরণ করে দেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে। জলাবদ্ধতার ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দায়সারা কাজের ব্যাপারে তিনি সতর্ক করলেও চট্টগ্রামবাসী কাক্সিক্ষত সেবা পায়নি।’

দলের এক সিনিয়র নেতা জানান, মহিউদ্দিন চৌধুরী চেষ্টা করেছেন করপোরেশনকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। এমন প্রকল্প নেওয়া হয় যাতে করপোরেশনকে জনগণের ট্যাক্সের ওপর নির্ভরশীল হতে না হয়। তাই তিনি কাঁচা-সেমিপাকা ঘরের ট্যাক্স মওকুফ করে দেন। সেখানে মেয়র নাছির হঠাৎ করে ১০ গুণের বেশি ট্যাক্স আরো করে জনগণের বিরাগভাজন হন। যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের নির্দেশে এটি বন্ধ হলেও মানুষের ক্ষোভ বন্ধ থাকে না। তাছাড়া সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকজন তার আস্থাভাজন প্রকৌশলীর অনিয়ম বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মেয়র কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা আরো প্রশ্রয় পায়। বিষয়টি সরকারের জন্য বিব্রতকর বলে অনেকে মন্তব্য করেন।

চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বঞ্চিত করে গতবার নেত্রীর একক সিদ্ধান্তে তরুণ নেতা হিসেবে তাকে মেয়র পদে দলের মনোনয়ন দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তার হাতে দলের গুরুত্বপূর্ণ মহানগরীর ‘সাধারণ সম্পাদক’ পদটিও তুলে দেন। কিন্ত তার গত ৫ বছরের কর্মকান্ডে তিনি এতটাই নাখোশ হন যে, সব ধরনের অনুরোধ-তদবির উপেক্ষা করে দলের মনোনয়ন থেকে তার নাম বাদ দেন। তবে মেয়র হিসেবে দলের মনোনয়ন না পেলেও তিনি এখনো দলের মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক। মহানগরী দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মেয়র নাছির কতটুকু ভূমিকা রাখবেন সেটা দেখার জন্য আপেক্ষা করতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close