রাকিবুল ইসলাম রাকিব, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ)

  ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯

মুচি বাবুলালের আকুতি

আমরা ছোটজাত, কেউ সহযোগিতা করে না!

শীতের আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে প্রকৃতি। আর এই সাত সকালেই ষাঁটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ সড়কের পাশে পাটি বিছিয়ে জুতা সেলাই করে চলছেন একমনে। এই বৃদ্ধের নাম বাবুলাল রবিদাস। গতকাল বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের গৌরীপুরের পাটবাজার এলাকার কথা হয় এ অভাবী মানষটির সঙ্গে, বেরিয়ে আসে তার সংসার জীবনের নানা দুঃখের কথা। জানা যায়, ওদের লাগামহীন অভাব আর মনোবেদনার কথা। তিনি আফসোস করে বলেন, ভগবান তো আমাদের ছোটজাত বানাইছে। আমাদের সহযোগিতায় তো কেউ সহজে এগিয়ে আসে না। কাছে যেতেই বৃদ্ধ লোকটি এ প্রতিনিধিকে বলে উঠেন ‘জুতা সিলি না জুতা কালী করবাইন’? সাংবাদিক পরিচয় দিলে ভুল ভাঙে তার। প্রতিদিনের সংবাদকে

তিনি জানান, তার নাম বাবুলাল রবিদাস। বাড়ি উপজেলার জেলখানা মোড় এলাকার মমিনপুর গ্রামে। দুই ভাইবোনের মধ্যে বাবুলাল সবার বড়। পৈতৃক সূত্রেই এ পেশায় আসা তার।

কথা বলতে বলতেই এক যুবকের পুরাতন জুতা সেলাই করছিলেন বাবু লাল। সুই-সুতোর ফোড়নে নিপুণ কৌশলে খুব দ্রুতই তিনি কাজটি সম্পন্ন করলেন। কাজ শেষে টাকা দিয়ে পারিশ্রমিক দিয়ে চলে যায় যুবক। নতুন কাস্টমারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে প্রতিদিনের সংবাদের প্রতিনিধি সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন বাবুলাল। তিনি বলেন, ‘অভাবের লেইগ্যা ইশকুলে যাওয়া অয় নাই। ছোটকাল থেইক্যাই বাপের লগে হাঁট-বাজারে এই কাম করি। বাপ মইর‌্যা গেলেও আমি অহনো এই কামেই লাইগ্যা আছি’।

বাবুলালের বাবা-মা মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর। বাবুলাল বিয়ে করেছেন ফুলদাসি রবিদাসকে। তাদের সংসারে পাঁচ ছেলে এবং তিন মেয়ে রয়েছেন। কিন্তু অর্থের অভাবে তার কোনো সন্তানই প্রাথমিকের গ-ি পেরোতে পারেননি। এরই মধ্যে তিন ছেলে বাদল, কার্তিক, সুবল ও দুই মেয়ে রানী, ঋতা বিয়ের পর আলাদা হয়েছেন। তারা বাবুলালের খুব একটা খোঁজ নেন না। বর্তমানে দুই ছেলে সুজন, পূজন ও এক মেয়ে সীমা ও স্ত্রীকে নিয়েই অভাব-অনটনে চলছে তার সংসার।

স্বাধীনতার আগে থেকেই পাটবাজার এলাকায় পাটি বিছিয়ে মুচির কাজ করতেন বাবুলাল। নব্বই দশকে বাবুলাল মুচির কাজ করে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকার মতো আয় করতেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় আশপাশে আরো মুচির দোকান হওয়ায় তার আয় রোজগার কমেছে। তার এখানে জুতা কালি ১৫ থেকে ২০ টাকা। এছাড়া ছেড়া জুতা সেলাই করে মেরামত করা হয় ৫ থেকে ১০ টাকায়। দিনশেষ তার আয় হয় এখন ৭০ থেকে ৯০ টাকার মতো।

বাবুলাল বলেন, ‘ঘরের ভিডা ছাড়া আমার আর কিচ্ছু নাই। যে টেকা কামাই করি, হেইডা দিয়া সংসার চলে না। শেষমেষ যে কবে দুইশ’ টেকা কামাই করছিলাম মনেও নাই। অভাবে পইড়্যা পোলা সুজইন্যারে ওয়াকশপের কামে দিছি। হে অহন সংসারে কিছু দেয়, হেরপরেও টানাটানি।’

বাবুলাল জানান, অনেকে তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। অভাবগ্রস্ত হলেও কেউ সাহায্য করে না। জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স ভুল হওয়ায় তিনি পান না বয়স্ক ভাতা। এসব নিয়ে বাবুলালের কোনো দুঃখ নেই। তবে তার দুঃখ শুধু ছোট মেয়ে সীমাকে নিয়েই। নান্দাইল থেকে মেয়ের বিয়ের ঘর এসেছে। কিন্তু টাকার জন্য বিয়ের আলাপটা সে এগোতে পারছেন না।

এরই মাঝে সকালের কুয়াশা কেটে গেছে। আকাশে খেলা করছে ঝলমলে রোদ। এমন সময় গল্পেযোগ হয় চা দোকানি হারুন। গ্যাসের চুলোয় চায়ের কেটলি বসিয়ে হারুন বলেন, ‘বাবুলাল অভাবী হলেও খুব সৎ মানুষ। জমি বেইচ্যা বড় দুই মাইয়্যারে বিয়া দিছে। কারো কাছে হাত পাতে নাই। কথার রেশ টেনে বাবুলাল বলেন, অহন মনে হয় হাত পাতন লাগবো রে হারুন। ছোট মাইয়্যার বিয়ার ঘর আইছে। এখনতো বেচনের মতো জমি নেই টাকাও নেই।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close