রাজশাহী ব্যুরো

  ২৮ মে, ২০১৮

রুয়েটে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে

প্রশাসনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনাই রুয়েটে একের পর অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম নিচ্ছে

শিক্ষানগরী রাজশাহীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শান্ত থাকলেও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) মাঝেমধ্যেই বিশৃঙ্খলা চলছে। গত ৮ মে রাতে রুয়েট ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এখন ছুটি চলছে রুয়েটে। ছুটির পরে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস আবারো অশান্ত হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রশাসনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনাই রুয়েটে একের পর অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম নিচ্ছে। অনিয়ম ও দলাদলিতে জড়ানোর অভিযোগ আছে বর্তমান ভিসি অধ্যাপক রফিকুল আলম বেগের বিরুদ্ধে। তবে তিনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ঠিক নয় বলে মত দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রুয়েটে গত প্রায় তিন বছর ধরে উপ-উপাচার্যের পদটি শূন্য। এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক পরিচয় দিয়ে রুয়েটে উপচার্য হিসেবে যারা যোগ দিয়েছেন তাদের অতীত কর্মকা- ছিল বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের সঙ্গে মিলেমিশে। ফলে আওয়ামীমনা শিক্ষক ও ছাত্রলীগের সঙ্গে বনিবনা হয়ে ওঠেনি ওই উপচার্যদের। এতে করে রুয়েটে কার্যত শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। বরং দিনের পর দিন বিশৃঙ্খলা বেড়েছে।

রুয়েট সূত্র মতে, চলতি বছরে একের পর এক অঘটনের জন্ম দিচ্ছে রুয়েট। এর আগে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর রুয়েট ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও পরে ওই কমিটির সুপারিশের আলোকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি প্রশাসন। এর আগে ২০১৩ সালে রুয়েট ছাত্রকল্যাণ দফতরে পদত্যাগকারী পরিচালকের বিরুদ্ধে তালা ঝোলানো ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ ওঠে। পদত্যাগী ছাত্রকল্যাণ পরিচালক শামীমুর রহমান দফতরে এসে পিয়নকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তালা ঝুলিয়ে দেন। এ ঘটনার মাসখানেক পরেই রুয়েট ছাত্রলীগের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের মাধ্যমে ভিসি সিরাজুল করিম চৌধুরীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ভিসি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন অধ্যাপক ড. সিরাজুল করিম চৌধুরী।

২০০৩ সালের জুন মাসে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপিপন্থী শিক্ষক নেতা অধ্যাপক ড. মো. শামীম আখতার ও ড. এসএম আবদুর রাজ্জাক, ড. মো. শফিউদ্দিন মিয়াকে নিয়ে জামায়াত-বিএনপি প্যানেলে ভোট করে ছিলেন সিরাজুল করিম চৌধুরী। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে সিরাজুল করিম চৌধুরীর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন করে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক প্যানেলে যোগ দেন তিনি। এরপর তিনি ২০০৯ সালে ভিসি হন। তার সময়কালেই ১০১২ সালের ১২ মার্চ ছাত্রলীগ নেতা আজিজ হত্যার শিকার হন। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে এ ঘটনা ঘটে।

সিরাজুল করিম চৌধুরীর সময়কালে রাজশাহী জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলকে কোটি কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয় রুয়েটে। অন্যদিকে, রুয়েটের সেলিম হলে প্রায় ১০ লাখ টাকার হাঁড়ি-পাতিল চুরির অভিযোগ উঠলেই জড়িত একজন শিক্ষকসহ অন্যদের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় আজও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিরাজুল করিম চৌধুরীর সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে ভিসির একক ক্ষমতাবলে একজন ছাত্রের রেজাল্ট বদল করে দেওয়া।

ভারপ্রাপ্ত ভিসি মর্ত্তুজার আমলে ৪টি ডাটা প্রসেসর পদে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ১০ জনকে একই পদে নিয়োগ দেন এবং অন্যান্য পদেও ১টি পদের বিপরীতে একের অধিক নিয়োগ দিয়ে তিনি বিতর্কিত হন। সেলিম হলে হাঁড়ি-পাতিল চুরির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন প্রফেসর ড. আশরাফুল আলমকে তিনি। প্রকৌশল বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী ও সাবেক শিবির নেতা আহসান হাবিবের মামা সাবেক জেলা যুবদলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলকে একাধিক ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেন ভিসি মর্ত্তুজা আলী।

নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ইউজিসি থেকে তৎকালীন সদস্য অধ্যাপক শিবলীকে প্রধান করে ভিসি মর্ত্তুজা আলীর বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় তখন। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ভারপ্রাপ্ত ভিসির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ২৮ মে অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বেগকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ২০০৩ সালে রুয়েটের বিএনপিপন্থী প্যানেল থেকে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন করে সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। পরে ২০০৬-০৭ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াতপন্থী ইঞ্জিনিয়ারদের সংগঠন এ্যাবে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন রাজশাহী কেন্দ্রের ভাইস চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীপন্থী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন।

বর্তমান ভিসি একটি পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে তার পরিচিতজনহ মোট ৮ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। অভিযোগে রয়েছে, ২০১৭ সালের শেষের দিকে বর্তমান ভিসি রফিকুল আলম বেগ রাজশাহী জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি ও শিক্ষক শফিউল আলম লেলিন হত্যা মামলার আসামি আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলকে আর্কিটেক্ট ভবনের ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার একটি কাজ পাইয়ে দেন অনিয়মের মাধ্যমে। এর বাইরেও বর্তমান ভিসি যোগদানের পর থেকেই ক্যাম্পাসে একের পর এক চুরি, ছিনতাই, মারপিট এমনকি হত্যাকা-ের মতো ঘটনাও ঘটেছে।

অন্যদিকে এই ভিসির আমলে ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই রূপালী ব্যাংক রুয়েট শাখা থেকে রুয়েটের রাজস্ব বাজেটের একটি চেক চুরি করে চলতি হিসাব নম্বর-১০৩ থেকে ৬ লাখ ৫১ হাজার টাকা রূপালী ব্যাংক রাজশাহী শাখা থেকে উত্তোলন করা হয়। রিতা এন্টার প্রাইজের নামে ওই টাকাগুলো উত্তোলন করা হয়। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের পর গত ১৯ সেপ্টেম্বর রুয়েটের অ্যাকাউন্টে টাকাগুলো ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু ওই ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বর্তমান প্রশাসন।

আরেকটি সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় রুয়েটে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল (আইকিউএসি) প্রকল্প নিয়েও নানা অয়িনমে জড়িয়ে পড়েছে বর্তমান প্রশাসন। ফলে থমকে আছে বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অভিজ্ঞতা নিয়ে সেগুলো নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শেয়ার করার মতো কাজগুলো। তবে বিদেশ ভ্রমণবাবদ লাখ লাখ টাকার বরাদ্দগুলো ঠিকই উত্তোলন করা হয়।

রুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি নিড়ি আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, কিছু নেতাকর্মী কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রুয়েটকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এ কারণেই একের পর এক ঘটনা ঘটছে। একই অভিযোগ করেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমানও।

রুয়েটের কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক নেতা ও বর্তমান সহকারী কন্ট্রোলার সেডু সরকার বলেন, রুয়েটে বিগত কয়েকজন ভিসি স্বাধীনতার পক্ষের লোক পরিচয় দিয়ে ভিসি হয়ে এলেও তারা আর তাদের জায়গায় শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। তাদের অতীত কর্মকা-গুলোর সঙ্গে তারা পুনরায় জড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসটাকে বিএনপি-জামায়াতের দোসরদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছেন। এ কারণেই রুয়েটে একের পর এক বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে নতুন করে ভিসি-প্রোভিসি কে হবেন, তা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপিং সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। এ কারণেও রুয়েটে অস্থিতিশীলতা কাটছে না।

রুয়েটের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, রুয়েটের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনাগুলোই ছাত্র সংগঠনের ওপর গিয়ে প্রভাব ফেলছে। কে ক্ষমতায় থাকবেন, আর কে আসবেন- তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রদের কাছে গিয়ে ধরনা দিচ্ছেন একেকজন শিক্ষক। ছাত্রলীগও এসব লুফে নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে। আবার শিক্ষকরাও নিজেদের দলাদলির মধ্যে জড়িয়ে পড়ছেন।

রুয়েটের শিক্ষক সমিতির এক নেতা বলেন, রুয়েটে চলছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। বর্তমান ভিসির মেয়াদের শেষদিকে এসে তিনিও নিজেকে আর সামলিয়ে নিতে পারছেন না। ফলে রুয়েটে অস্থিতিশীলতা থাকছেই। তবে ভিসি রফিকুল আলম বেগ তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কথা অস্বীকার করে বলেন, রুয়েটে কিছু ঘটনা ঘটেছে, তা ছাত্রলীগের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। এখানে প্রশাসনের কারণে কিছু ঘটেনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist