বদরুল আলম মজুমদার

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিএনপির ভাবনা

আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সুবিধা করতে পারছে না সরকার

দেশের চলমান রোহিঙ্গা সংকটে উদ্বিগ্ন বিএনপি। এ সমস্যা সমাধানে সরকার আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না বলে মনে করে দলটি। বিশেষ করে পাশের বড় দুটি দেশ ভারত ও চীনকে আস্থায় নিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সরকার। দলটির নেতারা মনে করেন, বিপুলসংখ্যক এ শরণার্থী সে দেশে ফেরত দেওয়াই বাংলাদেশের সামনে একমাত্র চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া মিয়ানমারের জাতীয় নেতা অং সান সু চির অবস্থানেরও সমালোচনা করেন বিএনপি নেতারা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে অহেতুক ঝামেলায় জড়িয়ে যেভাবে জাতিগত বিরোধের জন্ম দিয়েছেন, তাতে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ব্যাহত হতে পারে। তা ছাড়া যেসব দেশ মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় সহিংসতাকে সমর্থন করছে, তারা কাজটি ভালো করছে না বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা। এভাবে জাতিগত নিধন বিশ্বে খারাপ নজির হয়ে থাকবে।

গণহত্যাসহ বর্বর নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদে নিজ দেশে ফেরাতে বিভিন্নভাবে কাজ করছে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। এ বিষয়ে তিনি জনমত গঠনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছেন দলকে। এরই অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আজ রোববার বিকেল ৩টায় রাজধানীর গুলশানে হোটেল লেক শোরে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। এই গোলটেবিল বৈঠকে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবীসহ পেশাজীবীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, ইইউসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অন্য একটি সূত্র জানায়, বিএনপির থিংক ট্যাংক ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট রিসার্চ সেন্টার’ এই গোলটেবিল বৈঠকটি আয়োজনে মূল ভূমিকা রাখছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল বিএনপি। সংকট শুরুর পরই ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের গণহত্যা বন্ধে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত ১২ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্য দেশ এবং ওআইসির সদস্য দেশগুলোর ৫০ জন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ ও এর সমাধানে পাঁচ দফা সুপারিশসংবলিত চিঠি পাঠান। এ ছাড়া সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া এবং নিরাপত্তা দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একাধিক মানববন্ধন করে দলটি। সৃষ্ট সংকট নিয়ে গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিএনপি সরকারকে সহযোগিতা করতে চায়। সেই সঙ্গে সমস্যা যৌথভাবে মোকাবিলার জন্য জাতীয় ঐকমত্যের ডাক দেন তিনি। তবে সরকারের নৈতিবাচক মনোভাবে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘ঐক্যের ডাক দিতে দিতে আমরা ক্লান্ত। তার পরও আমরা বলতে চাই এ বিপুলসংখ্যক এ শরণার্থী মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। দলটির মহাসচিব বলেন, লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়া আজ একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তৈরি করতে হবে বিশ্ব জনমত।’ জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়ে সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ হয়েছে কি না-জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টার ব্যাপারে আমাদের কোনো ত্রুটি নেই। আমরা যোগাযোগ করছি, কথা বলছি। এরইমধ্যে প্রতিটি দল থেকেই ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে। এখন সেগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে হলে সরকারকেই দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবে আমাদের সরকার তো এমন ভাব দেখায় যে একাই এক শ। আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ নেই। সুতরাং তারা একাই সবকিছু করতে চায়। এ ধরনের মনোভাব থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।’

ফখরুল বলেন, ‘সরকার শুরুতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। তারা শুরুর দিকে রোহিঙ্গাদের ঢুকতেই দেয়নি। আমাদের চিৎকারে, আমাদের সোচ্চার কণ্ঠের কারণে দেশবাসীও সজাগ হয়েছে। দেশে রোহিঙ্গাদের পক্ষে তুমুল জনমত তৈরি হওয়ায় এবং বিশ্ববাসী যখন একে একে এগিয়ে আসতে শুরু করল, তখন সরকার যেতে বাধ্য হয়েছে। কেউ কেউ সেটাকে ভিন্নভাবে ব্যাখা করছেন, আমি সেগুলো বলতে চাই না। বরং তাদের বোধের উদয় হয়েছে। তারা সজ্ঞানে ফিরে এসেছেন। তারা রোহিঙ্গা আশ্রয় দিয়েছেন। এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। তিনি অভিযোগ করেন, সরকার এখন পর্যন্ত সেখানে প্রোপার ম্যানেজমেন্ট তৈরি করতে পারেননি। এখনো লাখ লাখ রোহিঙ্গা বৃষ্টির মধ্যে ভিজছে, কাদার মধ্যে ডুবে আছে। তাদের সুপেয় পানি ও খাদ্য-বস্ত্রের একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা তারা গড়ে তুলতে পারেনি। আমি অনুরোধ করব, সরকার অবিলম্বে এই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এটাকে শুধু রোহিঙ্গা মুসলমান বলার কারণ নেই। নির্যাতন হচ্ছে মানুষের ওপরে, মানবতার ওপরে। মানবতার যে অপমান করা হচ্ছে, মানবতাকে যে হত্যা করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে আমরা সবাই সোচ্চার হয়ে উঠেছি। আমরা বলে এসেছি, এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত জাতীয় ঐক্যের।’

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘মানবতার স্বার্থে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে চাই। আমরা বলতে চাই, সংকট সমাধানে সবার সহযোগিতা নিন। বিএনপি পাশে আছে। সবাই একত্রে কাজ করলে সারা বিশ্ব জানবে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল একত্রে কাজ করছে। ফলে দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে মিয়ানমার।’ বিএনপি ত্রাণ দিতে না পারায় সরকারের সমালোচনা করে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আত্মমানবতার সেবায় দাঁড়াতে পারব না। এটা হতে পারে না। এসব বন্ধ করুন। যারা রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করতে চায় তাদের সহযোগিতা করতে দিন। আপনারা সরকারে আছেন বিধায় আপনাদের কাজ শুধু শৃঙ্খলা রক্ষা করা। সেটাই করুন। যারা ত্রাণ নিয়ে যাবেন তাদের ত্রাণ দিতে দিন। ত্রাণ আপনাদের দিয়ে আসবে তারপর আপনারা অন্য লেভেল লাগিয়ে বিতরণ করবেন তা হবে না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্য সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকার রাজনৈতিকভাবে সোজা হওয়ার জন্যই রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতা বা নৈতিক কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণে সরকার তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের হলরুমে ‘রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের অবস্থান’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিরাপত্তার প্রশ্ন। সুতরাং রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। সবাইকে এক কাতারে আসতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুর শুরুতে যখন মানবিক বিপর্যয় ঘটছে তখন পুশব্যাক করা হলো। তখন এটাই ছিল বাংলাদেশের অফিসিয়াল অবস্থান। তখন রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী বলা হলো, কেউ কেউ মাদক পাচারকারী বলল। বিশ্বনেতারা যখন আসছেন, ত্রাণ আসছে, বিশ্ব জাগ্রত বিবেকবান মানুষের অবস্থান যখন পরিষ্কার, তারা যখন জাতি নিধন এবং এটা গণহত্যা বলা শুরু করলেন। দেশের সব মানুষ যখন মানবতার পক্ষে, দেশ ও দেশের বাইরের চাপ শুরু হলো, তখন সরকারের সুরও পরিবর্তন হয়েছে। এই হলো বর্তমান সরকারের সুবিধাবাদী অবস্থান।

তিনি আরো বলেন, ‘এই অঞ্চলের দেশগুলোর অবস্থান দেখেছি। সব দেশই নৈতিকতার দিক থেকে হেরে গেছে। যারা সু চির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তারা হেরে গেছে। তারা একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে উসকে দিচ্ছে। একটি জাতিকে স্টেটলেস করলে, সেই জাতির ভয় চলে যায়। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক লাভের চিন্তা দূরে থাক, নিরাপত্তার জন্য ভয়ংকর দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ জন্য রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।’ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিএনপি রাজনীতি করছে আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন সমালোচনারও জবাব দেন আমীর খসরু। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যু একটি বড় রাজনৈতিক বিষয়, এটা নিয়ে রাজনীতি হবেই। এই ইস্যুতে মতামত প্রকাশ করবে, বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেবে এটাই স্বাভাবিক। উগ্র জাতীয়তাবাদ দেখা দিয়েছে এই অঞ্চলে, যা ভয়ংকর একটা পরিস্থিতিতে ফেলছে এই অঞ্চলকে। এটা আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিষয় নয়, এটা জাতীয় ইস্যু। আমরা বারবার সহযোগিতার কথা বলে আসছি, কিন্তু কী সহযোগিতা করব। আমাদের ত্রাণ দিতে দেওয়া হচ্ছে না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বেশি দূরে যেতে হবে না। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯৭৮ সালে ও খালেদা জিয়া সরকারের ১৯৯২ সালে যে প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সরকার নিতে বাধ্য হয়েছে, ওই প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেই সমাধান সহজ হবে। এই ইস্যুতে জাতিগতভাবে দেশের সবাইকে একসুরে কথা বলে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এসব শরণার্থী রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে বলে মত দেন তিনি।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিএনপি,রোহিঙ্গা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist