নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২১ মে, ২০২৩

গাজীপুরে মুখে মুখে জাহাঙ্গীরের অতীত

আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন মো. জাহাঙ্গীর আলম। এর আগে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। দলীয় পদ এবং সরকারে থেকেও ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ ও গাজীপুরের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। গোপনে ধারণ করা তার এই মন্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে জাহাঙ্গীরের আপত্তিকর বক্তব্য শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান। এ ঘটনায় গাজীপুরের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ নিয়ে গাজীপুরে মেয়র-সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষও ঘটে। ওই বছর ৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের এক চিঠিতে জাহাঙ্গীর আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়ে ১৮ অক্টোবরের মধ্যে এর জবাব দিতে বলা হয়। তিনি জবাবও দেন। জবাবে ভিডিওটি সুপার এডিট করা বলে বারবার দাবি করেন। তারপরও তার শেষ রক্ষা হয়নি। মেয়র পদ হারান তিনি। 

এরপরই মুখ খুলতে শুরু করেছেন দলীয় নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ; তার উত্থান, অপকর্ম ও অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা ফিরছে মুখে মুখে। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীর আলমের বাবা কৃষক মিজানুর রহমান নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থেকে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার তুমুলিয়া ইউনিয়নের রাজনগর গ্রামে এসে বসতি গড়েন। পরে জয়দেবপুরের কানাইয়া গ্রামে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে কৃষিকাজের পাশাপাশি বাজারে গেঞ্জি বিক্রি করতেন। ওই গ্রামেই ১৯৭৯ সালে জন্ম জাহাঙ্গীর আলমের। দরিদ্র পরিবার হওয়ায় মামা মোহাম্মদ আলমের সংসারে বেড়ে ওঠেন জাহাঙ্গীর। ভর্তি হন গাজীপুরের চান্দনা উচ্চবিদ্যালয়ে। স্কুলজীবন থেকেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং স্থানীয় উল্কা সিনেমা হলে ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করে পকেট খরচ চালাতেন। এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন জেলার ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে। জাহাঙ্গীরের মামা মোহাম্মদ আলম সে সময়ের বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুর কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ করতেন। এ কারণে তার সঙ্গে জাহাঙ্গীরেরও সখ্য গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও ক্ষমতাধর লোকদের দালালি, তদবির এবং জেএমবি জঙ্গিদের কাছে বিস্ফোরক দ্রব্য সরবরাহ করে কোটি টাকার মালিক হয়ে যান অল্প সময়ে।

জাহাঙ্গীর একসময় এলাকায় ‘জেএমবি জাহাঙ্গীর’ নামেও পরিচিতি ছিলেন। ২০০৬ সালের দিকে বিস্ফোরক সরবরাহের অভিযোগে একবার গ্রেপ্তার হন পুলিশের হাতে। কিন্তু সে যাত্রায় পার পেয়ে যান।

মূলত জাহাঙ্গীরের রাজনৈতিক উত্থান ১৯৯৯ সালে। ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের ভিপি পদে ওই বছর জাহাঙ্গীর ছাত্রলীগের প্যানেলে নির্বাচন করেন। কলেজটি ছাত্রলীগের ঘাঁটি হলেও ব্যক্তিগত খাসলতের কারণে তিনি পরাজিত হন। কলেজের ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তিনি পরিচিতি পেয়ে যান। পরে এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সহসভাপতির দায়িত্ব পান।

২০০৯ সালে তিনি গাজীপুর সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে গাজীপুরে সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করেন। শিল্পনগরী গাজীপুরে বিভিন্ন গার্মেন্টে শুরু করেন ঝুট ব্যবসা। ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য বিস্তারের জন্য তৈরি করেন নিজস্ব বাহিনী। অল্প সময়ের ব্যবধানে জাহাঙ্গীর শত শত কোটি টাকা এবং বিঘার পর বিঘা জমির মালিক হন।

স্থানীয় অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জাহাঙ্গীরের টাকার পরিমাণ তিনি নিজেও জানেন না। হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বহু আগেই। তিনি এলাকায় পরোপকারী হিসেবেও বেশ পরিচিত। তার কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ ফেরত যায়নি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এমন কোনো মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নেই যেখানে জাহাঙ্গীর আর্থিক সহায়তা দেননি। এ ছাড়া জাতীয় শোক দিবসে মহানগরের ৫৭টি ওয়ার্ডে একটি করে গরু এবং নগদ অর্থ দিতেন কাঙালিভোজের জন্য। তবে এটাকে একটা কৌশল হিসেবে দেখছেন অনেকে। সামাজিক অনেক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে দ্রুতই জেলার বর্ষীয়ান সব আওয়ামী লীগ নেতাকে পেছনে ফেলে তিনি চলে আসেন সামনের কাতারে। অল্প সময়ে তার এ উত্থান এবং স্থানীয় জ্যেষ্ঠ নেতাদের অবমূল্যায়নের রাজনীতিতে বিভক্তির সৃষ্টি হয়। বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের লোকজন নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন দাতব্য সংস্থা জাহাঙ্গীর আলম ফাউন্ডেশন। আওয়ামী লীগের ব্যানারে সবকিছু করলেও দলীয় অনেক নেতাকর্মী ছিলেন সেখানে উপেক্ষিত। মহানগরের ৫৭টি ওয়ার্ডেই এ সংস্থার কমিটি রয়েছে। অনেকে বলছেন, এই ফাউন্ডেশনের আড়ালে জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগকে দুর্বল করে নিজের সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত কয়েকজন কাউন্সিলর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জাহাঙ্গীর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের ইচ্ছামতো চালাতে থাকেন সিটি করপোরেশন। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সভাতেই প্যানেল মেয়র নির্বাচন করার বিধি লঙ্ঘন করেন। তার মেয়াদের সাড়ে তিন বছর চলে গেলেও এখন পর্যন্ত প্যানেল মেয়র নির্বাচন করেননি। জাহাঙ্গীর চেয়েছিলেন সবাই তার হুকুমের দাস হয়ে থাকবে। এ ছাড়া মেয়র হওয়ার পরে তিনি নিজস্ব উদ্যোগে ৩০০ জনকে ট্রাফিক সহকারী নিয়োগ দেন। সড়ক-মহাসড়কগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তথাকথিত ট্রাফিক সহকারীদের হাতে সিটির যানজট নিরসনের দায়িত্ব তুলে দিয়ে ট্রাফিক পুলিশের পেশাদারিত্ব খর্ব করেন।

এ ছাড়া মহানগরীর ৮ হাজার বিঘা জমিতে ৮০০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণ করেছেন। এতে প্রায় ৩১ হাজার ঘরবাড়ি, মসজিদণ্ডমন্দির, কবরস্থান সরানো হয়েছে। রাস্তা নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ না করেই ইচ্ছামতো এসব করেন। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করলে মর্জিমাফিক নামমাত্র টাকা দিয়েছেন। অনেকে আবার সে টাকাও পায়নি। তার কারণে বহু মানুষ নিজের জমি হারিয়ে কেঁদেছেন।

জাহাঙ্গীর আলম প্রায়ই সংবাদ সম্মেলন ও নির্বাচনী প্রচারণায় বক্তব্য কালে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠানো হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার বিরুদ্ধে অন্যায় অবিচার করা হচ্ছে।

পিডিএস/মীর

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গাজীপুর,আওয়ামী লীগ,জাহাঙ্গীর আলম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close