গাজী শাহনেওয়াজ
নৌকার জয়ের পেছনে সাংগঠনিক শক্তি
অদৃশ্য কোন্দল ও নির্বাচনী সমন্বয়কের নিষ্ক্রিয়তায় হার বিএনপির
ভোট ও ফল ঘোষণা শেষে এবার জয়-পরাজয়ের কারণ খুঁজতে হিসাব নিয়ে ব্যস্ত ভোটাররা। চলছে নানা সমীকরণ। অংক কষেও তারা হিসাব মেলাতে পারছেন না ভোটের এই বড় ব্যবধানের। এখন চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সবখানেই ভোটের মাঠের জয়-পরাজয়ের খবর। এই চিত্র সদ্য শেষ হওয়া খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনের। এই নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছেন নৌকার প্রার্থী। পরাজয় ঘটেছে ধানের শীষের।
স্বচ্ছ এবং মাটি-মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের কারণে নৌকার চেয়ে কিঞ্চিত ‘ব্যক্তি বিবেচনা’য় এগিয়ে ছিলেন ধানের শীষের প্রার্থী। তবে, গত ১৫ মে ভোটের ফল সব পরিসংখ্যানকে এলোমেলো করে দিয়েছে। অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে জয়ের ব্যবধানটি। কারণ গত মেয়র নির্বাচনে তালুকদার আবদুল খালেক বিএনপির প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনির কাছে ৬১ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। এবার বিএনপির নতুন প্রার্থীর চেয়ে সাড়ে ৪ হাজার ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হন খালেক। তবে, গত সিটি নির্বাচনে ভোটের উপস্থিতি ছিল ৬৯ শতাংশ এবং এবার ৬২ শতাংশ অর্থাৎ ভোটার উপস্থিতি ৭ শতাংশ কমেছে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দু’দলের ইতিবাচক-নেতিবাচক কিছু তথ্য। টানা দু’মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দল-সমর্থিত নৌকার প্রার্থীর উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি জয়ের ক্ষেত্রে খানিকটা অবদান রেখেছে। অনুরূপভাবে, পরাজয়ের ক্ষেত্রে অতীতে একাধিকবার সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ধানের শীষের প্রার্থীর সদ্য বিদায়ী মেয়রের উন্নয়নের ব্যর্থতা ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়াও নির্বাচনের মাঠ দখলে ছিল ক্ষমতাসীনদের, সেদিক থেকে ঢের পিছিয়ে ছিল বিএনপি। এমনকি শঙ্কামুক্ত নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ ভোটারদের; পোলিং এজেন্ট নিয়োগে ছিল বিএনপির দুর্বলতা।
এছাড়া আওয়ামী লীগের এবারের জয়ের পেছনে নগরীর ব্যাপক উন্নয়ন কাজ মূল ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন অনেকে। নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু তার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাসের ঘটনা সামনে এনে ভোটারদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেন। তিনি বলেছিলেন, বিএনপি প্রার্থী জয়ী হলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ত্বরান্বিত হবে। তালুকদার খালেকের প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি নির্বাচিত হলে অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজ শেষ করবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত একজন সহকারী রিটার্নিং অফিসার বলেন, নির্বাচন দৃশ্যমান সুষ্ঠু হয়েছে। তবে, অবাধ ও নিরপেক্ষ বলা যাবে না। যতদিন পর্যন্ত নির্বাচনের সংস্কৃতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে অবাধ ও নিরপেক্ষতা যোগ না হবে, ততদিন আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রার্থীর জয়-পরাজয় নিয়ে অংক কষে নির্ধারণ সমীচীন হবে না।
মঞ্জুর পরাজয়ের কারণ : নজরুল ইসলাম মঞ্জু খুলনা বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। সাবেক সংসদ সদস্য। খুলনাঞ্চলের ধানের শীষের প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে অন্যতম। এবার কেসিসির দলীয় মেয়র প্রার্থী ছিলেন। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার প্রার্থীর কাছে প্রায় ৬৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন ধানের শীষের এই প্রার্থী। তবে, নির্বাচনে দৃশ্যমান শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু পরাজয়ের ক্ষেত্রে ভোট পাহারায় দলীয় নেতাকর্মীদের সংগঠিত না করতে পারা, পোলিং এজেন্ট ঠিকমতো কেন্দ্রে রাখতে ব্যর্থ হওয়া এবং বিদায়ী মেয়র মনি ও জেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুল ইসলাম মনাকে নির্বাচন কাজে কর্মী হিসেবে সম্পৃক্ত করতে না পারার চিত্র ছিল দৃশ্যমান। এক কথায় সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল নির্বাচনে পরাজয়ের ব্যবধান বাড়িয়েছে। এছাড়া দলীয় বিদায়ী মেয়রের উন্নয়ন জনসম্মুখে ভালোভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থতা এবং তার ব্যর্থতার কারণ সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারা, রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতের সব ভোট না পাওয়া এবং বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের নৌকার পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট চাওয়া; কিন্তু কেন্দ্রীয়ভাবে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে কাছে না টানা ছিল পরাজয়ের অন্যতম কারণ। শিল্প-অঞ্চল খ্যাত খুলনা নগরীতে আঞ্চলিক ভোট জয়-পরাজয়ে বড় ফ্যাক্ট সত্ত্বেও তাদের পুরোপুরি কাছে টানতে ব্যর্থতা পরাজয়কে ত্বরান্বিত করেছে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।
স্থানীয় একাধিক ভোটার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপে জানা গেছে নানা তথ্য। এ ব্যক্তিদের জন্য একজন ব্যাংকার মেহেদি হাসান। তিনি বলেন, নির্বাচনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে বিএনপি প্রার্থী এককভাবে নির্বাচন করছেন। তাকে কেউ সহযোগিতা করছেন, তেমন কাউকে নির্বাচনের মাঠে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে সমন্বয়কারী করা হয়েছিল। তার উপস্থিতি দৃশ্যমান ছিল না। তিনি আদৌ সমন্বয়ের কিছু করেছেন বলে মনে হয়নি। নিয়মানুযায়ী এলাকার বাইরের কারও পক্ষে শেষ সময় পর্যন্ত সমন্বয় করাও সম্ভব না। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল স্থানীয় কোনো নেতাকে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে তা করা হয়নি। ফলে সমন্বয়হীনতা প্রকট হয়ে উঠেছিল। মঞ্জুর নির্বাচনী সমন্বয়কারী কোথায় থাকলেন, কী করলেন—তা গণমাধ্যম বা বিএনপি নেতাকর্মীরা বুঝতে পারেননি।
তারা আরো বলেন, ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিজয়ী মেয়র মনিরুজ্জামান মনিকে মনোনয়ন কেন বিএনপি দিল না, তা ভোটার বা কর্মী-সমর্থকদের বোঝাতে পারেনি। সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনের কারণে বিএনপি কর্মী-সমর্থকদের একটা সহানুভূতি ছিল তার প্রতি। মনি ও তার সমর্থকরা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি। তার অনুসারী অনেকে ভেতরে ভেতরে তালুকদার আবদুল খালেকের পক্ষে কাজ করেছেন। এছাড়া কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিএনপির দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল, যারা মেয়রের পক্ষে কাজ করেননি। দলীয় মনোনয়ন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীরা মেয়র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি।
তাছাড়া জামায়াতের ভোটও পুরোপুরিভাবে পক্ষে নিতে পারেনি বিএনপি। বিশেষ করে বাগেরহাট-৩ রামপাল-মোংলা আসনে জামায়াতের অবস্থান শক্তিশালী। এটা তালুকদার আবদুল খালেকের আসন। এই আসনে জামায়াত সব সময় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তালুকদার আবদুল খালেক এই আসনে নির্বাচন না করলে, জামায়াতের সুবিধা হয়। নেপথ্যে জামায়াতের সঙ্গে তালুকদার আবদুল খালেকের এই কেন্দ্রিক একটা সমঝোতা হয়েছে বলে জানা যায়। ফলে জামায়াতের ভোট মঞ্জু পাননি, পেয়েছেন খালেক।
খালেকের জয়ের কারণ : খুলনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয় তালুকদার আবদুল খালেক প্রথমবার সিটি মেয়র নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে। দ্বিতীয় মেয়াদে ব্যর্থ হলেও এবার সরকার প্রধান থেকে গ্রিন সিগন্যাল নিয়েই এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করে নৌকায় ওঠেন। স্থানীয় যুবলীগ কিংবা সদর এমপি মিজানুর রহমান মিজানের নীরব বিরোধিতা সত্ত্বেও শেখ পরিবারের সদস্যদের মাঠে সক্রিয়তায় জয়ে অনেকটা এগিয়ে যায় নৌকা। কেন্দ্রীয়ভাবে কঠোর তদারকি এবং মাঠ দখলে নৌকা অনুসারীদের একাট্টা নির্বাচনে ভোটের ফলে বড় ভূমিকা রেখেছে। সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সব রকমের সহায়তা তো ছিলই। নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী এসএম কামাল নিবেদিত হয়ে কাজ করেছেন। কর্মীদের সংগঠিত করা, ভোট কেন্দ্রের সামনে জমায়েত, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, ভোটারদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, সবই করেছে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী। এছাড়া উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি, আঞ্চলিক ভোট, বিএনপির মিত্র জামায়াতকে ম্যানেজ এবং বিএনপির বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থন আদায় জয়ে এগিয়ে যায় নৌকা। এছাড়া স্থানীয় ভোটার, নির্বাচন কমিশন এবং গণমাধ্যম কর্মীদের তথ্যমতে, ২০-৩০টি কেন্দ্র দখল করে নৌকার পক্ষে সিলমারা কিছুটা জয়ে ভূমিকা রাখে। এমনকি, বিএনপি সমর্থিত সাধারণ ভোটারদের ভোটদানে বাধা জয়-পরাজয়ে ব্যবধান বাড়িয়েছে সদ্য শেষ হওয়া সিটি নির্বাচনে। তবে, কেন্দ্র দখল করে জোরপূর্বক ভোট না মানলেও নৌকা জয়ী হতো বলে মনে করেন স্থানীয় নগরবাসী। তাদের ভাষায়, এক্ষেত্রে কমত জয়-পরাজয়ের ব্যবধান।
পিডিএসও/হেলাল