বদরুল আলম মজুমদার

  ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

খালেদার সাজা কি বিএনপির শাপেবর!

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন পাঁচ বছরের সাজায় পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে। দলীয়-প্রধানের এমন সাজায় নেতাকর্মীরা স্বাভাবিকভাবেই বিক্ষুব্ধ এবং হতাশ। খালেদা জিয়ার কারাবন্দিকালে রাজনৈতিক করণীয় ও পরিস্থিতি নিয়ে দলের নেতারা করছেন চুলচেরা বিশ্লেষণ। অনেকের মতে, খালেদার অবর্তমানে দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে নিয়ে যাওয়া বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। আবার অনেকে মনে করছেন, জেলপরবর্তী বেগম জিয়ার প্রত্যাবর্তন দলটিকে করতে পারে আরো উজ্জীবিত। দলের ভেতর ও বাইরে আলোচনা আছে খালেদার এ জেলকে বিএনপি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বেশি লাভ বিএনপিরই হতে পারে।

এমন সম্ভাবনার কথা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, রায়পরবর্তী বিএনপির কর্মসূচির ধরন দেখে মনে হচ্ছে দলটি সঠিক পথেই আছে। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপিকে খারাপভাবে মাঠে নামানোর যথেষ্ঠ চেষ্টা হয়েছে। খালেদা জেলে যাওয়ার আগে পরে এমন চেষ্টা ছিল। কিন্তু দলের চেয়ারপারসনের সাজা হওয়ার পরও দলটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেই রয়েছে। এমন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে বিএনপি আগামী নির্বাচনের পথে ভালোভাবেই এগিয়ে যেতে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দেশের মানুষ রাজপথে গোলোযোগ বা আগুন সন্ত্রাসের মতো কর্মকাণ্ড এখন আর দেখতে চায় না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যও মনে করেন তাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, দেশের মানুষ মনে করে এটি একটি রাজনৈতিক মামলা। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ মামলা হয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও তখন ১৫টি মামলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সব কয়টি মামলা আদালতের মাধ্যমে সুরাহা করে নিয়েছেন। তাদের দলের নেতাদের বিরুদ্ধেও শত শত মামলা হয়েছিল, রাজনৈতিক বিবেচনায় সেসব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাকে ভুয়া কিছু তথ্য উপাত্ত দিয়ে সাজিয়ে তাকে জেলে দেওয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচন ও বেগম খালেদা জিয়ার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার জন্যই সরকার এ কাজ করেছে বলে দেশের মানুষ মনে করে। তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিকভাবে দুর্নীতির মামলায় কাউকে দোষী সাব্যস্ত করলে তাদের জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়। অতীতে এমনটা দেখা গেছে। যারাই রাজনৈতিক মামলায় সাজায় ছিলেন পরবর্তীতে তারাই রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলও মনে করেন, এ কারাদণ্ড বিএনপির জন্য নেতিবাচক না হয়ে বরং ইতিবাচক হতে পারে।

বিএনপিপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনায় বলেন, রায়ের কারণে বিএনপির কোনো অসুবিধা হয়নি। এতে জনগণের তাদের প্রতি সহানুভূতি বাড়ছে। কারণ রায় যে হয়েছে, এটা একটা প্রশ্নবিদ্ধ রায়। যার জন্য বেগম জিয়ার মামলাটা হয়েছে, সেই টাকাতো আর আত্মসাৎ হয়নি, তা ব্যাংকেই রয়ে গেছে। ব্যাংকে সেই টাকা সুদে আসলে এখন তিনগুণ হয়েছে। তাহলে এখানে আত্মসাৎ হলো কোথায়?

তিনি বলেন, রায়টা বৃহস্পতিবার দেওয়ায় জনগণ আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছে। এটা একটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায়, সরকারের নির্দেশনায় রায়। কারণ আগেই পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে রায় হয়েছে। তাহলে জজের সঙ্গে জেলারের কথা হয়েছিল নাকি যে বেগম জিয়ার শাস্তি হবে। যাই হোক, এতে বিএনপি লাভবান হয়েছে যদি তারা এটা গ্রহণ করতে পারে। কারণ বিএনপির যে বর্তমান কমিটি আছে, তারা এখনো ঘুমায়। তারা এই সুযোগটা গ্রহণ করতে পারবে কিনা—এটাই দেখার বিষয়।

বিএনপি প্রধানের সাজার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপির শরিক দল এলডিপির এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল অলি আহমদ বলেন, ১৫ দিনের মধ্যে হঠাৎ করে কেন নাজিমউদ্দীন রোডের পরিত্যক্ত কারাগার সংস্কার করা হলো? বিএনপি এই খবর রাখল না কেন? আর বৃহস্পতিবার রায়ের দিন দেওয়ার পেছনে কারণ ছিল শুক্র ও শনিবার খালেদা জিয়াকে জেলে রাখা। তাও আবার পরিত্যক্ত জেলে! সেখানে তাকে কয়েদিদের পোশাক পরানো হয়েছে বলে আমরা শুনেছি। এর সঙ্গে এরশাদ জড়িত আছে বলে আমি মনে করি। কারণ তিনিও নাজিমউদ্দীন রোডের জেলে এক সময় বন্দি ছিলেন। খালেদা জিয়ার এই রায় সরকারের পূর্বপরিকল্পিত দাবি করে এলডিপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অলি আরো বলেন, ৬৩২ পৃষ্ঠার রায় কিভাবে ১০ দিনের ভেতর লেখা সম্ভব হয়? প্রশ্ন করেন তিনি।

সাজাপরবর্তী বিএনপির তৃণমূল নেতারা কঠোর আন্দোলনের নির্দেশনা চাচ্ছিলেন শীর্ষ নেতাদের কাছে, কিন্তু দলীয় চেয়ারপারসন এমন কর্মসূচির পক্ষে সায় দিয়ে যাননি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খালেদার বরাত দিয়ে একাধিকবার এ কথা দলের নেতাদের বলেছেন। তিনি জানান, চেয়ারপারসনের নির্দেশনা হচ্ছে, যেকোনোভাবেই হোক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকতে। দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে। আর তাই খালেদা জেলে যাওয়ার পরের দুই দিন সাধারণভাবে বিক্ষোভের মতো ‘নরমাল’ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। গতকাল দুই দিনের এ কর্মসূচি অনেক গ্রেফতার ও পুলিশি নির্যাতনের মাধ্যমে শেষ হলেও বিএনপির শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বিষয়টি দেশ-বিদেশে ভালো ইমেজ তৈরি করতে সহায়তা করবে। পরের কর্মসূচি হিসেবে গতকাল নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, সোমবার মানববন্ধন, মঙ্গলবার অবস্থান এবং বুধবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অনশন কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। রিজভী বলেন, ‘অবস্থান কর্মসূচি হবে ১ ঘণ্টা। জেলাগুলো সুবিধামতো সময়ে তা করবে। ঢাকার অবস্থান কর্মসূচির স্থান পরে জানানো হবে।

দলীয় সূত্র জানায়, সরকার ধরেই নিয়েছিল, সাজা দিলে বিএনপি হরতাল অবরোধে যাবে, তখন বিএনপিকে দমন করার অজুহাত খুঁজে পাবে সরকারি দল। কিন্তু রায়ের পরে বিএনপিপ্রধান সেদিকে যেতে নিষেধ করায় হতাশ হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপির কৌশল নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেছে তারা। নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়াকে যেভাবে জেলে নেয়া হয়েছে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিএনপি নেতা বলেন, ভুয়া নথি বানিয়ে এই মামলায় রায় দেয়া হয়েছে। তাই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এতিমের টাকা চুরির অপবাদ দেশবাসী মেনে নেয়নি। সরকার ভেবেছিল খালেদা জিয়াকে জেলে নিলেই বিএনপি ভেঙে যাবে। কিন্তু উল্টো বিএনপি আরও শক্তিশালী হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে খালেদা জিয়া যতগুলো মিটিং করেছেন, যেভাবে দল গুছিয়েছেন—খালেদার অনপুস্থিতিতে সেটা নেতারা ধরে রাখতে সক্ষম হবেন।

এদিকে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খালেদা জিয়ার নাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। এখন আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়ার কারাবরণ। জাতিসংঘ বেগম জিয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে মামলা পর্যবেক্ষণ করছে। ভারত খালেদা জিয়ার কারাবরণ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। ঢাকায় কর্মরত প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকরা খালেদার মামলার বিষয়ে খোঁজ-খবরও রাখছেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিএনপি,খালেদার সাজা,রাজনীতি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist